ইসলামে সালাতের গুরুত্ব
লেখক: জাকিরুল্লাহ আবুল খায়ের
تأليف: ذاكر الله أبو الخير
সম্পাদনা : আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান
مراجعة: عبد الله شهيد عبد الرحمن ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ রিয়াদ
المكتب التعاوني للدعوة وتوعية الجاليات بالربوة بمدينة الرياض
تأليف: ذاكر الله أبو الخير
সম্পাদনা : আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান
مراجعة: عبد الله شهيد عبد الرحمن ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ রিয়াদ
المكتب التعاوني للدعوة وتوعية الجاليات بالربوة بمدينة الرياض
1429 – 2008
*************
সালাতের গুরুত্ব:
*********
আল্লাহ মানুষকে তার এবাদতের জন্যেই সৃষ্টি করেছেন। শুধু মানুষ নয় ; মানুষ ও জ্বীন-উভয় জাতিকে আল্লাহ তার এবাদত তথা তার দাসত্বের জন্য সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ বলেন-
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ (الذاريات :56)
অর্থাৎ আমি মানব ও জ্বীন জাতিকে একমাত্র আমার এবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।
ফলে তিনি মানুষের জন্য কিছু দৈহিক, আত্মিক ও আর্থিক এবাদতের প্রচলন করেছেন।
দৈহিক এবাদতের মাঝে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও মহান এবাদত হল সালাত। সালাত এমন একটি এবাদত যাকে আল্লাহ তার মাঝে এবং তার বান্দার মাঝে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যম সাব্যস্ত করেছেন।
সালাতের মাধ্যমে একজন মানুষ আল্লাহর সাথে দেয়া প্রতিশ্রুতির বার বার প্রতিফলন ঘটায়। সে তার প্রভু বা স্রষ্টাকে বুঝাতে সক্ষম হয় যে, সে তার প্রতিশ্রুতি পালন করে যাচ্ছে। এ সালাতের মাধ্যমেই মানুষ আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে। আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্কের বন্ধন সুদৃঢ় ও মজবুত হয়। ইহকাল ও পরকালের মুক্তির পথ কংটকমুক্ত হয়। সালাত ব্যক্তি, পরিবার, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তি, শৃঙ্খলা, ভ্রাতৃত্ব ও মমতাবোধ ফিরিয়ে আনে। গড়ে উঠে সামাজিক ঐক্য। সালাতের মাধ্যমে ছগীরা তথা ছোট ছোট গুনাহগুলো হতে পরিত্রাণ লাভ করে এবং দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ লাভ হয়।
সালাতের বৈশিষ্ট্য :—
সালাত এমন এক এবাদত যা সারা বছর দৈনিক পাঁচ বার আদায় করতে হয়। মৃত্যু ছাড়া আর কোন অবস্থাতেই সালাত মাফ হয় না এমনকি মৃত্যুশয্যাতেও সালাত হতে বিরত থাকার কোন বিধান নেই।
আল্লাহ তাআলা প্রথমে পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করেন। তারপর আল্লাহ মানুষের প্রতি দয়া করে তা কমিয়ে পাঁচ ওয়াক্তে নিয়ে আসেন। তবে সওয়াব ও বিনিময় পঞ্চাশ ওয়াক্তেরই জারী রাখেন। সুতরাং যে ব্যক্তি দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করবে আল্লাহ তাকে পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত আদায়ের সওয়াব প্রদান করবে।
সালাত একমাত্র এবাদত যা আল্লাহ তাআলা সাত আসমানের উপরেই ফরজ করাকে শ্রেয় মনে করেছেন। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মেরাজে গমন করেন তখন আল্লাহ তাআলা সরাসরি-কোন প্রকার মাধ্যম ছাড়াই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -কে সালাতের দায়িত্ব দেন।
এতে সালাতের মহত্ত্ব, মর্যাদা ও গুরুত্বের প্রতিফলন ঘটে। রব ও স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক স্থাপনে অভিপ্রায়ী একজন মুসলমানের কর্তব্য হল, সে এ মহান এবাদতটির মর্যাদা ও গুরুত্ব অনুধাবন করবে। এবং তার যথার্থতা বজায় রাখতে সচেষ্ট হবে। এছাড়া ও সালাতের অনেক লাভ ও ফজিলত আছে। নিম্নে এর কয়েকটি ফজিলত আলোচনা করা হল।
১- আল্লাহর একাত্ববাদ ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর রেসালাতের স্বাক্ষ্য দেয়ার পর সালাত হল ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি রুকন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামঈমাননের পরেই সালাতের কথা উল্লেখ করেন। অতঃপর তিনি বলেন –
بني الإسلام على خمس، شهادة أن لا إله إلا الله، وأن محمداً رسول الله، وإقام الصلاة، وإيتاء الزكاة، و صوم رمضان، وحج البيت. (رواه البخاري:7 و مسلم:19)
ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি : -
১-এ কথার সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন সত্যিকার ইলাহ নেই এবং মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামআল্লা¬হর রাসূল।
২-সালাত কায়েম করা।
৩-জাকাত প্রদান করা।
৪-রমজানের রোজা রাখা।
৫-বাইতুল্লাহর হজ করা। (বোখারি : ৭ মুসলিম : ১৯)
তিনি আরো বলেন -
رأس الأمر الإسلام، وعموده الصلاة، و ذروة سنامه الجهاد. (رواه الترمذي:)
সবকিছুর মূল হল ইসলাম, আর ইসলামের খুঁটি সালাত, আর ইসলামের শীর্ষ পীঠ হল জিহাদ। (তিরমিযি:৩৫৪১)
২-সালাত আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় ও সর্বোত্তম আমল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামবলেন :—
استقيموا ولن تحصوا، واعلموا أن خير أعمالكم الصلاة، ولن يحافظ على الوضوء إلا مؤمن. (رواه ابن ماجة:273)
তোমরা অটুট ও অবিচল থাক, গণনা করো না, আর মনে রাখবে তোমাদের সর্বোত্তম আমল হল সালাত, একজন মোমিন অবশ্যই সর্বদা ওজুর সংরক্ষণ করতে থাকে। (ইবনে মাজাহ :২৭৩)
৩- সালাত নূর- যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : -
الطهور شطر الإيمان، والحمد لله تملأ الميزان، وسبحان الله والحمد لله تملان أو تملأ ما بين السماء والأرض، والصلاة نور، والصدقة برهان، والصبر ضياء، والقرآن حجة لك أو عليك. رواه مسلم:327 )
পবিত্রতা ইমানের অর্ধেক আর আলহামদুলিল্লাহ পাল্লাকে সম্পূর্ণ করে, সুবহানালহ ও আলহামদুলিল্লাহ আসমান ও জমিনের মধ্যবর্তী স্থানকে পূর্ণ করে। সালাত নূর-আলো। দান খয়রাত প্রমাণ স্বরূপ। ধৈর্য উজ্জলতা আর কোরআন তোমার পক্ষে প্রমাণ অথবা তোমার বিপক্ষে প্রমাণ। (মুসলিম:৩২৭)
৪- সালাত আল্লাহর নৈকট্য ও উচ্চ-মর্যাদা লাভের উপকরণ। সাওবান (রা:) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -কে এমন আমল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন যা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে-রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামউত্তরে বললেন, তুমি বেশি করে আল্লাহর জন্য সেজদা-সালাত আদায় করতে থাক, কারণ তোমার প্রতিটি সেজদার কারণে আল্লাহ তোমার মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন এবং তোমার গুনাহ মাপ করবেন। (মুসলিম:৭৩৫ )
তিনি-সা. আরো বলেন -
أقرب ما يكون العبد من ربه وهو ساجد، فأكثروا الدعاء. ( رواه مسلم:744)
বান্দা আল্লাহর সবচেয়ে নৈকট্য লাভ করে যখন সে সেজদারত থাকে। সুতরাং তোমরা সেজদার অবস্থায় বেশি বেশি প্রার্থনা কর। (মুসলিম:৭৪৪)
৫- সালাত পাপ মোচনকারী এবং ছোট ছোট গুনাহের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : -
الصلوات الخمس والجمعة إلى الجمعة كفارة لما بينهن مالم يغش الكبائر. ( رواه مسلم:344)
পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, এক জুমা হতে আরেক জুমা মধ্যবর্তী গুনাহ সমূহের প্রায়শ্চিত্ত করে, যতক্ষণ পর্যন্ত সে কবিরা গুনাহে লিপ্ত না হয়। (মুসলিম:৩৪৪)
এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামগুনাহ প্রায়শ্চিত্তের একটি দৃষ্টান্ত এভাবে বর্ণনা করেন ; তিনি বলেন -
أرأيتم لوأن نهراً بباب أحدكم، يغتسل فيه كل يوم خمس مرات، هل يبقى من درنه شيء ؟ قالوا لا يبقى من درنه شيء، قال فكذلك مثل الصلوات الخمس، يمحو الله بهن الخطايا.) رواه مسلم:497)
যদি তোমাদের কারো বাড়ির দরজায় একটি পুকুর থাকে আর তাতে দৈনিক পাঁচবার গোসল করে, তার শরীরে কোন ময়লা আবর্জনা অবশিষ্ট থাকে ? সাহাবিরা উত্তরে বললেন, না। রাসূল সা. বলেন-অনুরূপ ভাবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ; আল্লাহ তাআলা দৈনিক পাঁচবার সালাত আদায় করা দ্বারা গুণাহ-পাপাচারগুলো ধুয়ে মুছে ফেলেন। (মুসলিম:৪৯৭)
তিনি আরো একটি দৃষ্টান্ত বর্ণনা করে বলেন -
إن العبد المسلم ليصلي الصلاة يريد بها وجه الله، فتهافت عنه ذنوبه، كما يتهافت هذا الورق عن هذه الشجرة. رواه أحمد:20576)
মুসলিম বান্দা যখন একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করে তখন তার গুনাহ এমনভাবে ঝরে পড়তে থাকে যেমন এই বৃক্ষের পাতা ঝরে পড়ে। (আহমদ : ২০৫৭৬)
৬-সর্ব প্রথম বান্দার সালাতের হিসাব নেয়া হবে। তাতে হয় সে মুক্তি পাবে অথবা ধ্বংস হবে। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামবলেন :—
أول ما يحاسب به العبد يوم القيامة الصلاة، فإن صلحت صلح سائرعمله، وإن فسدت فسد سائر عمله. ( رواه الترمذي:278)
কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম বান্দার সালাতের হিসাব হবে। যদি সালাত ঠিক হয় তবে তার সকল আমল সঠিক বিবেচিত হবে। আর যদি সালাত বিনষ্ট হয় তবে তার সকল আমলই বিনষ্ট বিবেচিত হবে। (তিরমিযি:২৭৮)
৭-সফলতা ও সম্মানিত স্থান জান্নাতে প্রবেশকে আল্ল¬¬হ তাআলা সালাতের উপরই স্থাপন করেছেন। তিনি বলেন : -
قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ ﴿1﴾ الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ ﴿2﴾.(سورة المؤمن)
মোমিনগণ সফলকাম, যারা তাদের সালাতে নম্রতা ও ভীতির সাথে দণ্ডায়মান হয়। (সূরা মোমিন : ১-২)
অতঃপর বলেন :—
وَالَّذِينَ هُمْ عَلَى صَلَوَاتِهِمْ يُحَافِظُونَ ﴿9﴾ أُولَئِكَ هُمُ الْوَارِثُونَ ﴿10﴾ الَّذِينَ يَرِثُونَ الْفِرْدَوْسَ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ ﴿11﴾ (سورة المؤمن)
“আর যারা তাদের সালাতে যত্নবান, তারাই জান্নাতের ওয়ারিশ-যারা ফিরদাউসের ওয়ারিশ হবে এবং তথায় তারা চিরকাল থাকবে।(সুরা আল-মোমিন:৯,১০,১১)
মনে রাখতে হবে সালাত যেহেতু আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় আমল আল্লাহর নৈকট্য লাভের ও মর্যাদা বৃদ্ধির কারণ, সালাতের হেফাজত করলে মুক্তি, অন্যথায় ধ্বংস ইত্যাদি-তাই নি:সন্দেহে বলা যায় যে সালাত একটি মহান কাজ যার গুরুত্ব দেয়া অতীব জরুরি। আর তা বাস্তবায়িত হয় সালাত, তার বিধানাবলী তথা রুকন ও ওয়াজিবসমূহ শিক্ষা, সালাতে একাগ্রতা ও পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যমেই।
উল্লেখিত ফজিলত লাভের উপযোগী কে হবেন ?
যার সালাতে নিম্ন বর্ণিত বিষয় পাওয়া যাবে, সেই একমাত্র উক্ত ফজিলত লাভের উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবে।
১-শরয়ি পদ্ধতি-যে পদ্ধতিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামসালাত আদায় করতেন। শর্ত পূর্ণ করা, সালাতের রুকন ও ওয়াজিব যথাযথ ভাবে আদায় করা এবং সুন্নতগুলো গুরুত্বের সাথে আদায় করতে চেষ্টা করা।
২- সালাত খুশু ও একাগ্রতার সাথে আদায় করা। আল্লাহ বলেন : -
قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ ﴿1﴾ الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ ﴿2﴾. سورة المؤمن:1,2
“মোমিনগণ সফলকাম, যারা তাদের সালাতে নম্রতা ও ভীতির সাথে দাঁড়ায়। (সুরা আল-মোমিন:১,২)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামবলেন :—
ما من مسلم تحضره صلاة مكتوبة، فيحسن وضوءها وخشوعها وركوعها إلا كانت كفارة لما قبلها من الذنوب، ما لم تؤت كبيرة، وذلك الدهر كله. رواه مسلم :335)
যে কোন মুসলমানের জন্য যখন ফরজ সালাতের সময় উপস্থিত হয়, অত:পর সে সুন্দরভাবে ওজু করে এবং সুন্দরভাবে রুকু সেজদা করে, এতে তার অতীতের সকল গুনাহ মাফ হয়ে যায়। যদি সে কোন কবিরা গুনাহ না করে, আর এভাবে সর্বদা চলতে থাকে। (মুসলিম:৩৩৫)
৩-সময় মত সালাত আদায় করা -
وقد سئل النبي صلى الله عليه وسلم أي العمل أحب إلى الله ؟ فقال الصلاة على وقتها، قيل: ثم أي؟ قال: بر الوالدين، قيل: ثم أي؟ قال: الجهاد في سبيل الله.) رواه البخاري:496)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -কে জিজ্ঞাসা করা হল, আল্লাহর নিকট কোন আমল সবচেয়ে বেশি প্রিয় ? তিনি বলেন-সময় মত সালাত আদায় করা, আবার জিজ্ঞাসা করা হল তার পর কোনটি? উত্তরে তিনি বলেন-মাতা পিতার সাথে সদাচরন করা। আবার জিজ্ঞাসা করা হল তার পর কোনটি? উত্তরে বললেন আল্লাহর পথে জিহাদ করা। (বোখারি:৪৯৬)
৪-মসজিদে জামাতের সাথে সালাত আদায় করা। জামাতে সালাত আদায় ওয়াজিব। (জামাতের বিস্তারিত আলোচনা পরবর্তীতে করা হবে।)
সালাত ফরজ হওয়ার হিকমত ও উপকারিতা:—
আল্লাহ সালাতকে তার ও বান্দার মাধ্যমে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যম সাব্যস্ত করেছেন, আল্লাহ অবশ্যই তার বান্দাদের মুখাপেক্ষী নন। তিনি তার বান্দাদের অবস্থা ও স্বভাব সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখেন। তিনি মহা মর্যাদাবান-পরাক্রমশীল তিনি বান্দার ডাকে সাড়া দেন এবং তাদের দোয়া কবুল করেন।
আল্লাহ মানুষের স্বভাব সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখেন, কারণ তিনি তাদের স্রষ্টা। তিনি বলেন -
أَلَا يَعْلَمُ مَنْ خَلَقَ وَهُوَ اللَّطِيفُ الْخَبِيرُ. (الملك :14)
যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি কি জানেন না ? তিনি সূক্ষ্মদর্শী সম্যক অবগত। (সুরা মুলক )
আল্লাহ মানুষের দুর্বলতা, অক্ষমতা, দরিদ্রতা ও অভাব-সবই জানেন। তিনি এও জানেন যে, তাদের এমন এক মহা শক্তি বিদ্যমান থাকা প্রয়োজন, যার নিকট তারা বিপদে আশ্রয় নিবে, তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করবে, অতপর আল্লাহ নিজেই তার বান্দাদের জন্য এর পথ ও প্রবেশদ্বার খুলে দেন-দৈনিক পাঁচ বার নির্দিষ্ট সময়ে বান্দা সে পথ ও প্রবেশদ্বারের ফটক খুলবে এবং এ ছাড়াও যখন ইচ্ছা প্রবেশ করতে পারবে। যেমন বকর আল মুযানী রহ.বলেন-
হে বনী আদম-আদম সন্তান ! তোমার মত আর কে হতে পারে ? তোমার মাঝে আর মিহরাবের ও পানির মাঝে কোন বাধা অবশিষ্ট রইল না। যখনই তুমি চাও আল্লাহর দরবারে প্রবেশ করতে পার তোমার ও প্রভুর মাঝে কোন মধ্যস্থতা কারী নেই।
মুসলিম বিন ইয়াছার বলেন, এমন স্বাদ আর কোন স্বাদ গ্রহনকারীই উপভোগ করতে পারেনি, যেমনটি উপভোগ করেন ঐ ব্যক্তি যে আল্লাহর সাথে নির্জনে কথোপকথন করে।
আল্লাহর- স্বীয় বান্দার প্রতি -অপার অনুগ্রহ হল, তিনি পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়ের বিনিময়ে পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত আদায়ের সওয়াব দান করবেন। এ মানুষের জন্য একটি মহান প্রতিদান, যাতে মানুষ এ সালাতকে স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করে এবং একে অধিক মনে না করে এবং তা আদায়ে কোন প্রকার অলসতা না করে।
উল্লেখিত বিষয়গুলো অনুধাবন করা ছাড়াও সালাত ফরজ হওয়ার হিকমত ও কিছু উপকারিতা জানা অতীব জরুরি। আর তা নিম্নরূপ :
১-আল্লাহর জিকিরের প্রতিষ্ঠা করা। সালাত মানুষকে তার স্রষ্টার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সুতরাং সালাতে অন্তরের উপস্থিতি প্রয়োজন। সালাত শুধু প্রাণহীন নড়াচড়ার নাম নয়। এই সালাত সম্পর্কে রাসূল সা: বলেন :—
وجعلت قرة عيني في الصلاة. (رواه النسائي:3878)
সালাতেই আমার চোখ জুড়ানো ও শীতলতা নিহিত। (নাসাঈ:৩৮৭৮)
এবং বেলাল রা: তিনি বলেন:
أقم الصلاة، أرحنا بها رواه أبوداود:4333)
তুমি সালাতের ব্যবস্থা কর এবং তার মাধ্যমে আমাকে তৃপ্ত কর। (আবু দাউদ:৪৩৩৩)
মূলত প্রকৃত মোমিনের জন্য সালাত এমন, মাছের জন্য পানি যেমন। মাছ পানি ছাড়া বাঁচতেই পারে না। অপর দিকে মুনাফেক দুর্বল ইমানদার সে সালাতে খাঁচায় আবদ্ধ পাখির মত, যে কোন উপায়ে সে তা হতে মুক্তি চায়।
২-সালাত একজন মুসলমানের মনোবল চাঙ্গা করে এবং শক্তি বৃদ্ধি করে। ফলে সে তার জন্য ইহকালীন জীবনের কষ্ট ক্লেশ এবং জাগতিক সকল প্রকার বিপদ আপদ মোকাবিলা করা সহজ হয়। আল্লাহ বলেন :—
وَاسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى الْخَاشِعِينَ ﴾ الَّذِينَ يَظُنُّونَ أَنَّهُمْ مُلَاقُو رَبِّهِمْ وَأَنَّهُمْ إِلَيْهِ رَاجِعُونَ ﴾. (البقرة 45.46)
এবং তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। অবশ্যই তা কঠিন কিন্তু বিনীতগণের জন্যে নয়। যারা ধারণা করে যে নিশ্চয় তারা তাদের প্রতিপালকের সাথে মিলিত হবে এবং তারা তারই দিকে প্রতিগমন করবে। (সুরা বাকারাহ : ৪৫,৪৬)
একারণেই যখন রাসূল সা: কোন বিষয়ে চিন্তিত হতেন তাড়াতাড়ি সালাতে মগ্ন হতেন। সালাতের মাধ্যমে একজন মোমিন সরাসরি তার প্রভুর সান্নিধ্য পৌঁছে। এবং আল্লাহর নিকট বিপদাপদ ও দু:শ্চিন্তার কারণ গুলো তুলে ধরেন। তার রহমতের ফটক উন্মুক্ত বা খুলে দেয়ার জন্য আকুতি পেশ করেন। একজন সত্যিকার মোমিন অবশ্যই সালাতে তৃপ্তি, প্রশান্তি ও সন্তুষ্টি অনুভব করে। সে আল্লাহু আকবর বলে সালাত আরম্ভ করার সময় অনুভব করে নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা সব কিছু হতে বড়। এবং সুরা ফাতেহা পড়ার সময় যখন-(আলহামদু লিল্লাহ) বলে তখন আল্লাহর নেয়ামতের অনুভূতিতে তার মন ভরে যায়। আর যখন সে (الرحمن الرحيم) পড়ে তখন সে অনুভব করে যে আমি রহমানের প্রতি কতই না মুখাপেক্ষী। তখন তার মানস্পটে আশা আরো বিশাল আকার ধারণা করে। আর যখন পড়ে (مالك يوم الدين) তখন আল্লাহর বড়ত্ব ও ইনসাফের কথা তার অন্তরে ফুটে উঠে আর ভয়ভীতি অনুভূত হয়। অত:পর সে স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে, এবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্য, আর তা আদায় করতে হলে প্রয়োজন আল্লাহর সাহায্য। সে প্রার্থনা করে এ বলে (إياك نعبد وإياك نستعين) অতঃপর সে স্মরণ করে যে, সে সর্বদা সঠিক পথের সন্ধান পাওয়ার মুখাপেক্ষী। তাই সে আল্লাহর নিকট দোয়া করে- اهدنا الصراط المستقيم
রাসূল সা: জিকির পবিত্রতা ও সালাতের ভূমিকা ও প্রভাবের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন-
يعقد الشيطان على قافية أحدكم إذا هو نام ثلاث عقد، يضرب على كل عقدة : عليك ليل طويل فارقد، فإن استيقط فذكر الله انحلت عقدة، فإن توضأ انحلت عقدة، فإن صلى انحلت عقدة، فأصبح نشيطاً طيب النفس، وإلا أصبح خبيث النفس كسلان. ( رواه البخاري:1074)
শয়তান ঘুমন্ত মানুষের ঘাড়ের পশ্চাতে তিনটি গিরা দেয়। আর প্রতিটি গিরায় সে বলে-আরে এখনও অনেক রাত বাকি তুমি ঘুমাও। আর যখন লোকটি ঘুম থেকে উঠে আল্লাহর জিকির করে তখন একটি ঘিরা খুলে যায়। আর যখন ওজু করে তখন তার আর একটি গিরা খুলে যায় আর যখন সালাত পড়ে আর একটি গিরা খুলে যায়। ফলে সে সকাল করে উদ্যমতা ও প্রফুল্ল মন নিয়ে। অন্যথায় সকাল করে অকর্মা এবং অপবিত্র মন নিয়ে (বোখারি:১০৭৪ )
এবং কাফেররাও সালাতের পর আত্মতৃপ্তি ও অধিক কর্মোদ্যমী হওয়ার কথা স্বীকার করে। তাদের সালাতের যদি এ অবস্থা হয়, তাহলে মুসলমানদের সালাতের অবস্থা কেমন হওয়া উচিত ?
৩- সালাত মোমিনের অন্তর ও মনুষত্বকে শক্তিশালী করতে সহযোগিতা করে এবং তাকে কল্যাণকর কাজে উৎসাহ জোগায় ও খারাপ কাজ হতে বিরত থাকার জন্য শক্তি জোগায়। এছাড়া সালাত অন্তরে আল্লাহর ধ্যানকে বদ্ধমূল করে এবং ওয়াক্ত সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি পূরণে সমর্থন দেয় এবং প্রবৃত্তির চাহিদা ও আলস্যকে পরাজিত করে। আল্লাহ বলেন :—
إِنَّ الْإِنْسَانَ خُلِقَ هَلُوعًا ﴿19﴾ إِذَا مَسَّهُ الشَّرُّ جَزُوعًا ﴿20﴾ وَإِذَا مَسَّهُ الْخَيْرُ مَنُوعًا ﴿21﴾ إِلَّا الْمُصَلِّينَ ﴿22﴾ الَّذِينَ هُمْ عَلَى صَلَاتِهِمْ دَائِمُونَ ﴿23﴾. (المعارج19-23)
মানুষ তো সৃজিত হয়েছে অতিশয় অস্থির চিত্তরূপে। যখন বিপদ তাকে স্পর্শ করে তখন সে হয় হা-হুতাশকারী। আর যখন কল্যাণ তাকে স্পর্শ করে তখন হয় অতি কৃপণ। তবে নামাজিরা ব্যতীত, যারা তাদের সালাতে সদা নিষ্ঠাবান। (সুরা মাআরিজ ১৯-২৩) আল্লাহ আরো বলেন -
وَأَقِمِ الصَّلَاةَ إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَر.ِ (العنكبوت)
এবং সালাত কায়েম কর। নিশ্চয় সালাত অন্যায় ও অশ্লীল কাজ হতে বিরত রাখে। (সুরা আনকাবুত -৪৫)
সালাত ত্যাগকারীর বিধান
সালাত ত্যাগ করার মত আর কোন বড় গুনাহ হতে পারে না। সালাত ত্যাগ করার মানে হচ্ছে ইসলামের স্তম্ভ-খুঁটি ভেঙে চূর্ণবিচুর্ণ করা। ইসলামের মাঝে সালাত সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা সত্ত্বেও সালাত পরিত্যাগ করা যে কত বড় গুনাহ তা বর্ণনা দেয়ার অবকাশ রাখে না। আমরা কোরানের আয়াতগুলোর প্রতি লক্ষ্য করলে দেখতে পাই যে আল্লাহ সালাত ত্যাগকারীদের নয়, বরং ভুলে সালাত আদায় করেনি এমন ব্যক্তিকে কঠিন হুমকি দিয়েছেন, আর যারা নামাজ ত্যাগকারী ও সালাত নষ্টকারী, তাদের কি পরিণতি হবে, তা বলাই বাহুল্য।, দেখুন আল্লাহ সালাত ভুলে যাওয়া ব্যক্তিদের সম্পর্কে বলেন -
فَوَيْلٌ لِلْمُصَلِّينَ ﴿4﴾ الَّذِينَ هُمْ عَنْ صَلَاتِهِمْ سَاهُونَ ﴿5﴾ (الماعون)
আর পরিতাপ সেই নামাজিদের জন্য, যারা তাদের সালাতে অমনোযোগী। (সুরা মাঊন:৪-৫)
সালাত বিনষ্টকারীদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন -
فَخَلَفَ مِنْ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ أَضَاعُوا الصَّلَاةَ وَاتَّبَعُوا الشَّهَوَاتِ فَسَوْفَ يَلْقَوْنَ غَيًّا. (مريم:59)
তাদের পর আসল অপদার্থ পরবর্তীগণ -তারা সালাত নষ্ট করল ও লালসা পরবশ হল ; সুতরাং তারা অচিরেই কুকর্মের শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে। (সুরা মারয়াম :৫৯)
অসংখ্য হাদিস দ্বারাও সালাত ত্যাগ কারীর ক্ষতি প্রমাণিত হয় এবং কোন কোন হাদিসে সালাত ত্যাগকারীকে কাফেরও বলা হয়। যেমন, রাসূল সা: এর বাণী, তিনি বলেন : -
بين الرجل وبين الشرك والكفر ترك الصلاة. (رواه مسلم:116)
ব্যক্তি ও কুফর-শিরকের মাঝে ব্যবধান হল সালাত ত্যাগ করা। (মুসলিম:১১৬ )
তিনি আরো বলেন : -
العهد الذي بيننا وبينهم الصلاة، فمن تركها فقد كفر. (رواه أحمد:21859)
আমাদের মাঝে আর অমুসলিমদের মাঝে চুক্তি হল সালাত, যে ব্যক্তি সালাত ছেড়ে দিল সে কাফের হয়ে যাবে। (আহমদ:২১৮৫৯)
রাসূল সা: জামাতে সালাত পড়া হতে বিরত থাকে এমন লোকদের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। সমগ্র ওলামায়ে কেরাম ঐক্যমত পোষণ করেন যে, যারা নামাজ ফরজ হওয়াকে অস্বীকার করে তারা কাফের, আর যারা সালাতের প্রতি উপহাস-বিদ্রূপ ও সালাতকে গুরুত্বহীন মনে করে ছেড়ে দেয় তারাও কাফের।
ওলামাগণ বলেন -আর যে ব্যক্তি সালাত ওয়াজিব হওয়াকে স্বীকার করে কিন্তু অলসতা বা অমনোযোগী হওয়ার কারণে সালাত ত্যাগ করে, তখন কর্তৃপক্ষ তাকে তওবা করার জন্য আদেশ দেবে। যদি সে তাওবা করে তাকে ক্ষমা করা হবে আর যদি তওবা না করে এবং সালাত ত্যাগের উপর অটল থাকে -তাকে হত্যা করার ব্যাপারেও সকলে ঐক্যমত পোষণ করেন।
তার এ হত্যা করাটা কি হদ হিসেবে নাকি মুরতাদ বা কাফের হিসাবে ?-এ বিষয়ে ওলামাদের মাঝে মত পার্থক্য আছে। যারা বলেন হদ হিসাবে হত্যা করা হবে তাদের মতানুসারে তার জানাজা পড়া হবে, মুসলমানদের কবরে তাকে দাফন করা হবে, এবং মুসলমান উত্তর সুরীরা তার সম্পত্তিতে মীরাছ পাবে। আর যেসব ওলামা বলেন-তাকে কাফের হিসেবে হত্যা করা হবে, তাদের মতে তার উপর জানাজা পড়া হবে না, তাকে মুসলমানদের কবরে দাফন করা হবে না এবং তার সম্পত্তি মুসলমানদের বাইতুল মালে মালে ফাই বলে গণ্য হবে তার পরিবার পরিজন কেউ ওয়ারিশ হতে পারবে না।
সালাত ত্যাগের পরিণতির বিষয়ে বিশেষ ভাবে চিন্তা করে দেখুন। সালাত ত্যাগী অবশ্যই প্রদীপ্ত আগুন তথা জাহান্নামের সন্নিকটেই অবস্থান করছে। তাই আমাদের উচিত খুব তাড়াতাড়ি তওবা করা এবং দ্রুত সালাত প্রতিষ্ঠা করা এবং সালাতে যত্নবান হওয়া।
ভাষাগত সম্পাদনা : কাউসার বিন খালিদ /ওয়েব গ্রন্থনা : আবুল কালাম আযাদ আনোয়ার /সার্বিক যত্ন : আবহাছ এডুকেশনাল এন্ড রিসার্চ সোসাইটি, বাংলাদেশ
*************************************************************************************
ইসলামের সোনালি যুগঃ মদিনা সনদ থেকে খেলাফতে রাশেদা
সৃষ্টিগতভাবেই মানুষ সামাজিক জীব। মানব জীবনে একাকিত্ব অকল্পনীয়। ইসলাম স্বভাবজাত সর্বজনীন ধর্ম হিসেবে তাতে সবার জন্য সর্বাবস্হার সর্বোত্তম সমাধান বিদ্যমান। ব্যক্তি জীবন থেকে নিয়ে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনের সব সমস্যার সমাধান ও নমুনা তাতে রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে ‘তোমাদের জন্য রাসুলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ’।
মানুষের জান, মাল ও মান-মর্যাদার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং জাতীয় ও সংঘবদ্ধ বহু কাজ আঞ্জাম দিতে রাষ্ট্রের অপরিহার্যতার কথা বলাই বাহুল্য। তাই প্রয়োজনের তাগিদে পৃথিবীর শুরু থেকেই ক্ষুদ্র পরিসরে অঘোষিত ব্যবস্হা চলে আসছিল। তবে তার পরিধি ছিল মানুষের প্রয়োজন ও বিচরণ হিসেবে। মানুষের প্রয়োজন বিচরণ ও কালের চক্রাবর্তে বহু পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের পর বর্তমানে চলমান আমাদের এ ব্যবস্হা। সর্বযুগের মানুষই সাধ্যমত উন্নত ও ভালো ব্যবস্হাপনায় কসরত করেনি। সম্প্রতি রাষ্ট্র ব্যবস্হাকে আরো সুন্দর সুশৃংখল ও উন্নত করতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নামে তা পাঠ্য সিলেবাসেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এসব আয়োজন প্রশংসার বিষয় নিশ্চয়। কিন্তু ইসলাম বহু আগেই রাষ্ট্র ব্যবস্হার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে তার সুফল বাস্তবে প্রমাণ করেও দেখিয়েছে। ঐতিহাসিক প্রমাণের ভিত্তিতে যে সব রাষ্ট্রনীতির বিবরণ পাওয়া যায় তার প্রথমটি হলো ঐতিহাসিক মদিনা সনদ। যার প্রণেতা স্বয়ং রাসুলে আরাবি (সা.)। ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন মহানবী (সা.)। পরবর্তী সময়ে খোলাফায়ে রাশেদগণ তার পদাংক অনুসরণ করে কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের জন্য অনুসরণীয় রাষ্ট্রের নমুনা স্হাপন করেছেন।
আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অন্য সব চেষ্টা ও আন্তরিক প্রচেষ্টার পাশাপাশি তাদের সফলতার মুলমন্ত্রগুলো খুঁজে দেখা যেতে পারে। হজরত আবু বকর ইসলামের প্রথম খলিফা। মজলিসে শুরার সিদ্ধান্তে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তার জন্য সামান্য ভাতা নির্ধারণ করা হয়। এতে পরিবারের অপরিহার্য প্রয়োজন মিটত মাত্র। কিন্তু শখ-আহ্লাদ পুরণ করার মতো কোনো সুযোগ তাতে হতো না। স্ত্রীর একদিন মিঠাই খেতে ইচ্ছে হয়। তিনি খরচের টাকা থেকেই বেশ কয়েক দিনে কিছু বাঁচিয়ে মিঠাই আনতে স্বামীর হাতে টাকা তুলে দেন। খলিফাতুল মুসলিমীন কিছুক্ষণ নীরব থেকে শান্ত কণ্ঠে বলেন, ‘তাহলে এর চেয়ে কম বেতনেই আমার পরিবারের চাহিদা মিটে যায়, তবে আর বেশি কেন! বাইতুল মালে গিয়ে তার ভাতা থেকে সে পরিমাণ বরাদ্দ কমিয়ে দেন। অতঃপর মৃত্যুর আগে নিজ সম্পদ বিক্রি করে বাইতুল মালের গৃহীত ভাতা ফিরিয়ে দেয়ার অসিয়ত করে যান।
হযরত ওমর (রা.) ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা। অর্ধজাহানের সফল বাদশা। দিনে রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম আঞ্জাম দিয়ে দেশের বাস্তব চিত্র দেখতে এবং প্রজাদের খোঁজ-খবর নিতে রাতে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াতেন। এক রাতের ঘটনা-হযরত ওমর (রা.) এক ঘরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। ঘরে শিশুদের কান্না শুনে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। খবর নিয়ে দেখেন তাদের আয়-রোজগার করার মতো কেউ নেই। খাবারের অভাবে ক্ষুধার জ্বালায় তারা কাঁদছে। মা শিশুদের সান্ত্বনা দিতে পাতিলে পানি জ্বাল দিচ্ছেন শুধু। এ দৃশ্য দেখে ওমর দিশেহারা। দৌড়ে বাইতুল মালে গিয়ে খলিফা নিজেই আটার বস্তা কাঁধে নিয়ে ছুটলেন। নিজ কাঁধে নিতে গোলাম বহু পীড়াপীড়ি করল কিন্তু ওমরের একটি মাত্র কথা, এ দায়িত্ব আমার, খোদার কাছে আমি কি জবাব দেব?
হযরত ওমর (রা.) প্রজাদের মাঝে একটি করে কাপড় বিতরণ করলেন। যা দিয়ে কারো একটি জামা বানানো সম্ভব নয়। জুমার দিন ওমর খুৎবা দিতে মিম্বারে দাঁড়িয়েছেন, অথচ তার গায়ে সে কাপড়ের জামা। উপস্হিত জনতার সযত্ম জিজ্ঞাসা, খলিফাতুন মুসলিমীন আমাদের কাপড় দিয়ে তো একটি করে জামা হয়নি, তাহলে আপনি অতিরিক্ত কাপড় কোথায় পেলেন? অর্ধজাহানের ক্ষমতাধর বাদশার মুখে কৈফিয়তের বিনম্র স্বর-কাপড় তো তোমাদের সমানই পেয়েছি আমিও, তবে আমার ছেলে আব্দুল্লাহ ও আমার দু’জনের কাপড় একত্র হয়ে এ জামা তৈরি হয়েছে।
হযরত ওমর ইবনে (আ.) আযীয রহ. বিখ্যাত তাবেঈ। খেলাফতে রাশেদার পর যিনি ইসলাম প্রতিষ্ঠায় নজির স্হাপন করেছেন। খলিফা হওয়ার পর স্ত্রীকে ডেকে বললেন ‘দেখ খেলাফতের গুরুদায়িত্ব এখন আমার কাঁধে। তুমি আমার স্ত্রী, সারা দেশের লোকদের আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করা পর্যন্ত আমার ঘরে সম্পদ থাকবে তা হতে পারে না। স্ত্রী ছিলেন পুর্ববর্তী বাদশার আদরের দুলালি সম্পদশালী মহিলা। মহিয়সী নারী তার সব গহনাসহ অন্য সব সম্পদ বাইতুল মালে জমা করতে স্বামীর হাতে তুলে দেন। ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় কিংবদন্তী এ খলিফা খেলাফতের দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রখ্যাত তাবেঈ হাসান বসরি (রহ.)-এর কাছে ন্যায়বিচারক শাসকের পরিচয় জানার মিনতি লিখে পাঠান। উত্তরে হাসান বসরি (রহ.) যে অমুল্য উপদেশ দিয়েছিলেন তা কিয়ামত পর্যন্ত সব ন্যায়নিষ্ঠ শাসকের রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য গাইড লাইন হয়ে আছে।
‘হে আমীরুল মুমিনীন! ন্যায় বিচারক শাসক হলেন রক্ষণশীল রাখালের ন্যায়। যে তার পশুর জন্য উত্তম চারণভুমি অনুসন্ধান করে। অনুপযোগী চারণভুমি থেকে পশুকে ফিরিয়ে রাখে এবং হিংস্র প্রাণী থেকে তাদের রক্ষা করে।
হে আমীরুল মুমিনীন! ন্যায় বিচারক শাসক হলেন দায়িত্বশীল পিতার ন্যায়। যিনি শৈশবে বাচ্চার সব প্রয়োজন মিটান, বড় হলে তাকে উত্তম শিক্ষা দেন। তার জীবদ্দশায় সন্তানের জন্য খেটে উপার্জন করেন এবং ভবিষ্যৎ চিন্তা করে সন্তানের জন্য সম্পদ সঞ্চয় করেন। হে আমীরুল মুমিনীন! ন্যায় বিচারক শাসক হলেন স্বজনপ্রিয় মায়ের ন্যায়। যিনি কষ্ট করে সন্তান গর্ভে ধারণ করেন, সিমাহীন কষ্টে তাকে প্রসব করেন এবং শৈশবে সন্তানকে সযত্মে লালন করেন, তার আরামের জন্য বিনিদ্র রজনী কাটান, তার অস্তিত্বের কথা চিন্তা করে তাকে দুধ পান করান, আবার তার চাহিদা বুঝে ভিন্ন খাবারের ব্যবস্হা করেন, তার সুখে সুখী হন এবং তার দুঃখে দুঃখী হন।
পুর্ববর্তী সফল রাষ্ট্র নায়কদের জীবন ও কর্মের পর্যালোচনা করলে তাদের আত্মশুদ্ধি ত্যাগ ও কোরবানির কথাই স্পষ্ট ফুটে উঠে। সেসব মহা মনীষীর ত্যাগ ও কোরবানির বদৌলতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ন্যায়, ইনসাফ, নিরাপত্তা ও সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টনের বিরল দৃষ্টান্ত। কায়েম হয়েছিল ইসলামী রাষ্ট্র জীবনের সোনালি ইতিহাস।
*****************************************************
E-mail-pubalibatashe@gmail.com
আ ব্দু ল্লা হ মু কা র র ম
আমার দেশ, ২৪ মে ২০০৮
****************************************************
শবেবরাত ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ
শা’বান আরবী বর্ষপঞ্জির অষ্টম মাস, এ মাসকে রাসুল (সাঃ) তাঁর নিজের মাস বলে আখ্যায়িত করেছেন। মাহে, রমযানুল মোবারককে যথাযথভাবে বরণ করে নেয়ার প্র‘তির মাস হিসেবেও একে অভিহিত করা হয়। বর্ষপরিক্রমায় যখনই মাসটি ঘুরে আসতো তখনই রাসুল (সাঃ) মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে দোয়া করতেনঃ আল্লাহুমা বারিকলানা ফি রাজাবা ওয়া শাবানা ওয়াবাল্লিগনা ইলা রামাদান। অর্থাৎ: হে আল্লাহ! আপনি আমাদের রজব ও শাবানের বরকতদান করুন এবং আমাদেরকে রমযান পর্যন্ত জীবিত রাখুন। মধ্য শাবানের শবে বরাতের মশহুর ফজিলতের কথা কোরআন-হাদীসের অসংখ্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত।E-mail-pubalibatashe@gmail.com
**************************************************
ব্যতিক্রমধর্মী সাহাবা হযরত আবু যর গিফারী (রা·)
হযরত আবু যর গিফারী (রাঃ) ছিলেন রাসূল (সাঃ) এর একজন প্রিয় সাহাবী। তার পূর্ব পরিচিত ছিল এরূপঃ বাইরের জগতের সাথে মক্কার সংযুক্তি ঘটিয়েছে যে, আদ্দান উপত্যকাটি, সেখানেই ছিল গিফার গোত্রের বসতি। জুনদুব ইবনে জুনাদাহ আবু যর নামেই যিনি পরিচিত-তিনিও ছিলেন এ কবীলার সন্তান। বাল্যকাল থেকেই তিনি অসীম সাহস, প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও দূরদৃষ্টির জন্য ছিলেন সকলের থেকে স্বতন্ত্র। জাহেলী যুগে জীবনের প্রথম ভাগে তার পেশাও ছিল রাহাজানি। গিফার গোত্রের একজন দুঃসাহসী ডাকাত হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তবে কিছুদিনের মধ্যে তার জীবনে ঘটে যায় এক পরিবর্তন। তার গোত্রীয় লোকেরা এক আল্লাহ ছাড়া সকল মূর্তির পূজা করত। তাতে তিনি গভীর ব্যথা অনুভব করতেন। কিছুদিন পরেই তিনি নিজেই ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হলেন।
তার ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটি বেশ চমকপ্রদ। ইবনে হাজার ‘আল ইসাবা’ গ্রন্থে তার ইসলাম গ্রহণের কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। সংক্ষেপে এভাবে বলা যায়, তিনি তার গোত্রের সাথে বসবাস করছিলেন। একদিন সংবাদ পেলেন মক্কায় এক নতুন নবীর আবির্ভাব হয়েছে; তাই তিনি তার ভাই আনিসকে ডেকে বললেনঃ তুমি একটু মক্কায় যাবে। সেখানে যিনি নিজেকে নবী বলে দাবি করেন এবং আসমান থেকে তার কাছে ওহী আসে বলে প্রচার করে থাকেন; তার সম্পর্কে কিছু তথ্য সংগ্রহ করবে, তার মুখের কিছু কথা শুনবে। তারপর ফিরে এসে আমাকে অবহিত করবে। আনিস মক্কায় চলে গেলেন। রাসূল (সাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করে তার মুখ নিঃসৃত বাণী শ্রবণ করে নিজ গোত্রে ফিরে এলেন। আবু যর (রাঃ) খবর পেয়ে তখনই ছুটে গেলেন আনিসের কাছে। অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে নতুন নবী সম্পর্কে নানান কথা তাকে জিজ্ঞেস করলেন। আনিস বললেনঃ কসম আল্লাহর। আমি তো লোকটি দেখলাম, মানুষকে তিনি মহৎ চরিত্রের দিকে আহ্বান জানাচ্ছেন। আর এমন কথা বলেন যা কাব্য বলেও মনে হল না। মানুষ তার সম্পর্কে কি বলাবলি করে? কেউ বলে- তিনি একজন যাদুকর, কেউ বলে গণক, আবার কেউ বলে কবি। আল্লাহর কসম। তুমি আমার তৃষ্ণা মেটাতে পারলে না। আমার আকাঙক্ষাও পূরণ করতে সক্ষম হলে না। তুমি কি পারবে আমার পরিবারের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে, যাতে আমি মক্কায় গিয়ে স্বচক্ষেই তার অবস্থা দেখে আসতে পারি? তবে আপনি মক্কাবাসীদের সম্পর্কে সতর্ক থাকবেন।
পরদিন সকালে আবুযর চললেন মক্কার উদ্দেশ্যে। সাথে নিলেন কিছু পাথেয় ও এক মশক পানি। সর্বদা তিনি শংকিত, ভীত চকিত। কোন ব্যক্তির কাছে মুহাম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে কোন কথা জিজ্ঞেস করা তিনি সমীচীন মনে করলেন না। কারণ, তার জানা নেই এ জিজ্ঞাসিত ব্যক্তিটি মুহাম্মদের বন্ধু না শত্রম্ন? দিনটি কেটে গেল। রাতের আঁধার নেমে এল। তিনি ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। বিশ্রামের উদ্দেশ্যে তিনি শুয়ে পড়লেন মাসজিদুল হারামের এক কোণে। আলী ইবন আবী তালিব যাচ্ছিলেন সে পথ দিয়েই। দেখে তিনি বুঝতে পারলেন লোকটি মুসাফির। ডাকলেন, আসুন আমার বাড়িতে। আবুযর গেলেন তার সাথে এবং সেখানেই রাতটি কাটিয়ে দিলেন।
সকালবেলা পানির মশক ও খাবারের পুঁটলিটি হাতে নিয়ে আবার ফিরে এলেন মাসজিদে। তবে দু’জনের একজন ও একে অপরকে কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। পরের দিনটিও কেটে গেল। কিন্তু নবীর সাথে পরিচয় হল না। আজো মাসজিদে শুয়ে পড়লেন। আজো আলী (রাঃ) আবার সে পথ দিয়েই যাচ্ছিলেন। বললেনঃ ব্যাপার কি, লোকটি আজো তার গন্তব্যস্থল চিনতে পারেনি? তিনি তাকেই আবার সাথে করে বাড়িতে নিয়ে গেলেন। এ রাতটি সেখানে কেটে গেল। এদিনও কেউ কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না। একইভাবে তৃতীয় রাতটি নেমে এল। আলী (রাঃ) আজ বললেন- বলুন তো আপনি কি উদ্দেশ্যে মক্কায় এসেছেন? তিনি বললেন, যদি আমার কাছে অঙ্গীকার করেন, আমার কাঙিক্ষত বিষয়ের দিকে আপনি আমাকে পথ দেখাবেন, তাহলে আমি বলতে পারি। আলী (রাঃ) অঙ্গীকার করলেন। আবু যর বললেনঃ আমি অনেক দূর থেকেই মক্কায় এসেছি নতুন নবীর সাথে সাক্ষাৎ করতে এবং তিনি যেসব কথা বলেন, তার কিছু শুনতে। আলীর (রাঃ) মুখ-মণ্ডল আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, আল্লাহর কসম, তিনি নিশ্চিত সত্য নবী। একথা বলে তিনি নানাভাবে নবীর (সাঃ) পরিচয় দিলেন। তিনি আরো বললেন, সকালে আমি যেখানেই যাই, আপনি আমাকে অনুসরণ করবেন। যদি আমি আপনার জন্য আশংকাজনক কোনকিছু লক্ষ্য করি তাহলে প্রস্রাবের ভান করে দাঁড়িয়ে যাব। আবার যখন চলব, আমাকে অনুসরণ করে চলতে থাকবেন। এভাবে আমি যেখানে প্রবেশ করি আপনিও সেখানে প্রবেশ করবেন। প্রিয়নবী দর্শন লাভ ও তার ওপর অবতীর্ণ প্রত্যাদেশ শ্রবণ করার প্রবল আগ্রহ ও উৎকণ্ঠায় আবু যর সারাটা রাত বিছানায় স্থির হতে পারলেন না। পরদিন সকালে মেহমান সাথে করে আলী (রাঃ) চললেন রাসূল (সাঃ)-এর বাড়ির দিকে। আবু যর তার পেছনে পেছনে। পথের আশপাশের কোনকিছুর প্রতি তার ভ্রম্নক্ষেপ নেই। এভাবে তারা পৌঁছলেন রাসূল (সাঃ)-এর কাছে। আবু যর সালাম করলেন। আসসালামু আলাইকা ইয়া রাসূলুল্লাহ। রাসূল (সাঃ) জবাব দিলেন, ওয়া আলাইকাস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ ওয়া বারাকাতুহ। এভাবে আবু যর সর্বপ্রথম ইসলামী কায়দায় রাসূল (সাঃ)-কে সালাম পেশ করার গৌরব অর্জন করেন। অতঃপর সালাম বিনিময়ের এ পদ্ধতিই গৃহীত ও প্রচারিত হয়।
রাসূল (সাঃ) আবু যরকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন এবং কুরআনের কিছু আয়াত তেলাওয়াত করে শোনালেন। সেখানে বসেই আবু যর কালেমায়ে তাওহীদের পাঠ করে নতুন দ্বীনের মধ্যে প্রবেশের ঘোষণা দিলেন এবং তার সাথে সাথেই তাওহীদের বাণী পৌঁছে দেয়ার জন্য ওঠে-পড়ে লেগে গেলেন। আবু যর (রাঃ) বলেন-আমি মসজিদে এলাম। কুরাইশরা তখন একত্রে বসে গুজব করছে। আমি তাদের মাঝে হাযির হয়ে যতদূর সম্ভব উচ্চকণ্ঠে সম্বোধন করে বললাম, কুরাইশ গোত্রের লোকেরা আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, এক আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, মুহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহর রাসূল। এ কথা বলার সাথে সাথেই কুরাইশরা ভীত-চকিত হয়ে পড়ল এবং একযোগে সবাই আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং আমাকে বেদম প্রহার শুরু করল। রাসূলের চাচা- আব্বাস আমাকে চিনতে পেরে তাদের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আমাকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করলেন। একটু সুস্থ হয়ে আমি রাসূল (সাঃ)-এর কাছে ফিরে গেলাম। আমার অবস্থা দেখে তিনি বললেন, তোমাকে ইসলাম গ্রহণের কথা প্রকাশ করতে নিষেধ করেছিলাম না? বললাম ইয়া রাসূলুল্লাহ! নিজের মধ্যে এক প্রবল ইচ্ছা অনুভব করছিলাম। সে ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছি মাত্র।
আল্লামা ইবনে হাজার আসকালীন আল-ইসাবা গ্রন্থে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের সূত্রে বর্ণনা করেছেন- রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন তাবুকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন, তখন লোকেরা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে যুদ্ধে গমনের ব্যাপারে ইতস্ততঃ প্রকাশ করতে লাগল। কোন ব্যক্তিকে দেখা না গেলে সাহাবীরা বলতেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ অমুক আসেনি। জবাবে তিনি বলতেন, যদি তার উদ্দেশ্য মহৎ হয়, তাহলে শিগগিরই আল্লাহ তাকে তোমাদের সাথে মিলিত করবেন। এক সময় আবুযরের নামটি উল্লেখ করে বলা হল, সেও পিঠটান দিয়েছে।
প্রকৃত ঘটনা হল, তার উটের ছিল মন্থর গতি। প্রথমে তিনি উটটিকে দ্রুত চালাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে ব্যর্থ হয়ে জিনিসপত্র নামিয়ে নিজের কাঁধে উঠিয়ে হাঁটা শুরু করেন এবং অগ্রবর্তী মানজিলে রাসূল (সাঃ)-এর সাথে মিলিত হন। এক সাহাবী দূর থেকে তাকে দেখে বলে উঠলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ রাস্তা দিয়ে কে একজন যেন আসছে। তিনি বললেনঃ আবু যরই হবে। লোকেরা গভীরভাবে নিরীক্ষণ করে চিনতে পারল এবং বলল, ইয়া রাসূলুল্লাহ, আল্লাহর কসম, এতো আবু যরই। তিনি বললেন, আল্লাহ আবু যরের ওপর রহমত করুন। সে একাকী চলে, একাকীই মরবে, কিয়ামতের দিন একাই উঠবে। (তারীখুল ইসলামঃ আল্লামা যাহাবী ৩য় খণ্ড)।
রাসূল (সাঃ)-এর দ্বিতীয় ভবিষ্যৎ বাণীটি অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। হযরত আবু যর ছিলেন প্রকৃতিগতভাবেই সরল, সাদাসিধে, দুনিয়াবিরাগী ও নির্জনতা প্রিয় স্বভাবের। এ কারণে রাসূল (সাঃ) তাঁর উপাধি দিয়েছিলেন- ‘মসিরুল ইসলাম।’ রাসূল (সাঃ)-এর ওফাতের পর তিনি দুনিয়ার সাথে একেবারেই সম্পর্কহীন হয়ে পড়েন। প্রিয় নবীর বিচ্ছেদে তাঁর অন্তর অভ্যন্তরে যে দাহ শুরু হয়েছিল তা আর কখনো প্রশমিত হয়নি।
হযরত আবু যর (রাঃ) এর ওফাতের কাহিনীটিও অত্যন্ত বেদনাদায়ক। হিজরী ৩১ মতান্তরে ৩২ সনে তিনি রাবজার মরুভূমিতে ইন্তেকাল করেন। তাঁর সহধর্মিনী তাঁর অন্তিমকালীন অবস্থার বর্ণনা করেছেন এভাবে- আবু যরের অবস্থা যখন খুবই খারাপ হয়ে পড়ল, আমি তখন কাঁদতে শুরু করলাম। তিনি বললেন, কাঁদছ কেন? বললামঃ এক নির্জন মরুভূমিতে আপনি পরকালের দিকে যাত্রা করছেন। এখানে আমার ও আপনার ব্যবহ্নত বস্ত্র ছাড়া অতিরিক্ত এমন বস্ত্র নেই যা দ্বারা আপনার কাফন দেয়া যেতে পারে। তিনি বললেনঃ কান্না থামাও। তোমাকে একটি সুসংবাদ দিচ্ছি। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে একজন মরুভূমিতে মৃত্যুবরণ করবে এবং তার মরণের সময় মুসলিমদের একটি দল সেখানে অকস্মাৎ উপস্থিত হবে। আমি ছাড়া সে লোকগুলোর সকলেই লোকালয়ে ইন্তেকাল করেছে। এখন মাত্র আমিই বেঁচে আছি। তাই নিশ্চিতভাবে বলতে পারি সে ব্যক্তি আমিই।
সেই কাফেলাটি হল ইয়ামেনী। তারা কুফা থেকে এসেছিল। আর তাদের সাথে ছিলেন বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ)। এ কাফিলার সাথে তিনি ইরাক যাচ্ছিলেন। তিনিই আবু যরের জানাযার ইমামতি করেন এবং সকলে মিলে তাকে রাবজার মরুভূমিতে দাফন করেন।
**************************
মা ও লা না শা হ মো হা ম্ম দ হা বি বু র র হ মা ন
দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ জুলাই, ২০০৮
E-mail-pubalibatashe@gmail.com
****************************************************
নামাজের দৈহিক উপকারিতা
ইসলাম ধর্মে যে পাঁচটি কাজকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে তার মধ্যে নামাজ অন্যতম। এটা এমন একটি ইবাদত যা মানুষকে মহান আল্লাহপাকের কাছাকাছিই করে না, শারীরিক কল্যাণও সাধিত হয়। আমাদের প্রিয় নবী সাঃ বলেছেন, ‘পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ হলো কারো বাড়ির পার্শ্ব দিয়ে প্রবাহিত স্রোতধারার মতো। কোনো ব্যক্তি তাতে পাঁচবার গোসল করলে যেমন গায়ে ময়লা থাকতে পারে না, তেমনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও মানুষকে পবিত্র করে দেয়।’ আর আল্লাহপাক পবিত্র কালামে পাকে ৮২ বার নামাজ কায়েমের কথা বলেছেন। নামাজের ফলে শুধু সওয়াব অর্জনই হয় না দৈহিকভাবেও অনেক উপকার পাওয়া যায়। নামাজ উত্তম ব্যায়াম। অলসতা ও বিষণ্নতার যুগে নামাজই একমাত্র ব্যায়াম যা দ্বারা ইহকালীন বেশিরভাগ ব্যথার উপশম হয়। সঠিক পদ্ধতিতে নামাজ আদায় করলে অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেমন মস্তিষ্ক, গর্দান, সিনা ও ফুসফুস সতেজ থাকে। এর ফলে হায়াত বৃদ্ধি পায়।
পবিত্র ধর্ম ইসলাম কতটা বৈজ্ঞানিকভাবে সমৃদ্ধ তা বোঝা যায় নামাজের সময়সূচি দ্বারা। মানুষ সারারাত শুয়ে ঘুমায়, ফলে বিভিন্ন অঙ্গ নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তাই রাখা হয়েছে তাহাজুদ্দের ও ফজরের নামাজ। অতঃপর কিছুক্ষণ বিরতি নাস্তার জন্য। পরে এশরাক্ ও চাশ্তের নামাজ। কাজে কর্মে মানুষকে ব্যস্ত থাকতে হয় বলে লম্বা বিরতির পরে জোহরের নামাজ রাখা হয়েছে। রাতে এশার নামাজটা বিতর ও হাল্কি নফলসহ দীর্ঘ করা হয়েছে। কারণ অনেকেই হজমের সুবিধার জন্য এশার নামাজের আগেই পানাহার সেরে ফেলেন। কাজেই আল্লাহ কত সুপরিকল্পিতভাবে নামাজের সময় বেঁধে দিয়েছেন ভাবতে অবাক লাগে।
পবিত্র ধর্ম ইসলাম প্রায় ১৫০০ বছর আগে যে পদ্ধতি উপহার দিয়েছিল আজ তা উত্তম শরীরচর্চা হিসেবে প্রমাণিত। একজন বিখ্যাত চিকিৎসক স্নায়ুর দুর্বলতা, জোড়ায় জোড়ায় ব্যথা এবং অন্যান্য মাংসপেশীর ব্যাধির জন্য অনেক চিকিৎসা করিয়েছেন। পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি। তারপর নামাজের দ্বারা ভালো হয়ে উঠেছেন। (সূত্রঃ প্রফেসরস্ কারেন্ট এফেয়ার্স) তিনি এক পর্যায়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ওষুধ সেবন পরিত্যাগ করেছিলেন এবং নিয়মিত নামাজ আদায় দ্বারা সুস্থ হলেন। এ ঘটনা থেকে ওই চিকিৎসক শিক্ষা নিলেন এবং তার প্রত্যেক মুসলিম রোগীকে যারা, চলাফেরায় সক্ষম তাদের নামাজ পড়তে বলেন। নামাজের প্রতিটি রুকু ও সিজদা সঠিকভাবে আদায় করে তার বেশিরভাগ রোগী আরোগ্য লাভ করতে লাগল।
এরপর ডাক্তার সাহেব নামাজ দ্বারা যেসব রোগ নিরাময় হয় তার একটি তালিকা তৈরি করলেন। নামাজ দ্বারা আটটি রোগ থেকে মুক্তি লাভ করা যায়। সেগুলো হলো ১. মানসিক রোগ ২. স্নায়ুবিক রোগ যা বর্তমানে বেড়ে গেছে আর দেশে ভালো নিওরোলজিস্টের খুব সঙ্কট ৩. অস্থিরতা, ডিপ্রেশন ৪. মনস্তাত্ত্বিক রোগ ৫. হার্টের রোগ ৬. জোড়ায় ব্যথা ৭. ইউরিক অ্যাসিড থেকে সৃষ্ট রোগ এবং ৮. পাকস্থলী ও আলসারের রোগ। এ তালিকা তৈরি করেছেন একজন বিখ্যাত ফিজিশিয়ান, কোনো মৌলভী সাহেব নন। তাই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নামাজ পড়লে আল্লাহ্ খুশি হবেন, আমরা জান্নাতবাসী হব, না পড়লে জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হবে এটা ভাবলেও চিকিৎসাশাস্ত্রে এর প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অপরিসীম।
সবশেষে ইউরোপের এক ব্যক্তির ভ্রমণ কাহিনীর কিছুটা বিবরণ তুলে ধরছি। তিনি লিখেছেন, আমি একদিন নামাজ পড়ছিলাম আর এক ইংরেজ দাঁড়িয়ে তা দেখছিল। আমার নামাজ পড়া শেষ হলে সে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি এখন যেভাবে ব্যায়াম করলে তা নিশ্চয়ই আমার লেখা বই থেকে জেনেছ, কেননা আমি এ পদ্ধতিতে ব্যায়ামের কথা লিখেছি।’ আমি বললাম, আমি তো মুসলমান। আমার ধর্ম ইসলাম আমাকে রোজ পাঁচবার এভাবে ধর্মীয় কাজের আদেশ দিয়েছে। আমি আপনার কোনো ব্যায়ামের বই পড়িনি। সেই ইংরেজ তখন অবাক হয়ে বলল, ‘যে ব্যক্তি প্রতিদিন এ পদ্ধতিতে ব্যায়াম করবে সে কখনো দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল রোগে আক্রান্ত হবে না।’ পরে ওই ইংরেজ ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন বিষয়ে ধারণা নিতে লাগল।
**************************
এ জে ইকবাল আহমদ
দৈনিক নয়া দিগন্ত, ২২ আগষ্ট ২০০৮
*****************************
পবিত্র ধর্ম ইসলাম কতটা বৈজ্ঞানিকভাবে সমৃদ্ধ তা বোঝা যায় নামাজের সময়সূচি দ্বারা। মানুষ সারারাত শুয়ে ঘুমায়, ফলে বিভিন্ন অঙ্গ নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তাই রাখা হয়েছে তাহাজুদ্দের ও ফজরের নামাজ। অতঃপর কিছুক্ষণ বিরতি নাস্তার জন্য। পরে এশরাক্ ও চাশ্তের নামাজ। কাজে কর্মে মানুষকে ব্যস্ত থাকতে হয় বলে লম্বা বিরতির পরে জোহরের নামাজ রাখা হয়েছে। রাতে এশার নামাজটা বিতর ও হাল্কি নফলসহ দীর্ঘ করা হয়েছে। কারণ অনেকেই হজমের সুবিধার জন্য এশার নামাজের আগেই পানাহার সেরে ফেলেন। কাজেই আল্লাহ কত সুপরিকল্পিতভাবে নামাজের সময় বেঁধে দিয়েছেন ভাবতে অবাক লাগে।
পবিত্র ধর্ম ইসলাম প্রায় ১৫০০ বছর আগে যে পদ্ধতি উপহার দিয়েছিল আজ তা উত্তম শরীরচর্চা হিসেবে প্রমাণিত। একজন বিখ্যাত চিকিৎসক স্নায়ুর দুর্বলতা, জোড়ায় জোড়ায় ব্যথা এবং অন্যান্য মাংসপেশীর ব্যাধির জন্য অনেক চিকিৎসা করিয়েছেন। পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি। তারপর নামাজের দ্বারা ভালো হয়ে উঠেছেন। (সূত্রঃ প্রফেসরস্ কারেন্ট এফেয়ার্স) তিনি এক পর্যায়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ওষুধ সেবন পরিত্যাগ করেছিলেন এবং নিয়মিত নামাজ আদায় দ্বারা সুস্থ হলেন। এ ঘটনা থেকে ওই চিকিৎসক শিক্ষা নিলেন এবং তার প্রত্যেক মুসলিম রোগীকে যারা, চলাফেরায় সক্ষম তাদের নামাজ পড়তে বলেন। নামাজের প্রতিটি রুকু ও সিজদা সঠিকভাবে আদায় করে তার বেশিরভাগ রোগী আরোগ্য লাভ করতে লাগল।
এরপর ডাক্তার সাহেব নামাজ দ্বারা যেসব রোগ নিরাময় হয় তার একটি তালিকা তৈরি করলেন। নামাজ দ্বারা আটটি রোগ থেকে মুক্তি লাভ করা যায়। সেগুলো হলো ১. মানসিক রোগ ২. স্নায়ুবিক রোগ যা বর্তমানে বেড়ে গেছে আর দেশে ভালো নিওরোলজিস্টের খুব সঙ্কট ৩. অস্থিরতা, ডিপ্রেশন ৪. মনস্তাত্ত্বিক রোগ ৫. হার্টের রোগ ৬. জোড়ায় ব্যথা ৭. ইউরিক অ্যাসিড থেকে সৃষ্ট রোগ এবং ৮. পাকস্থলী ও আলসারের রোগ। এ তালিকা তৈরি করেছেন একজন বিখ্যাত ফিজিশিয়ান, কোনো মৌলভী সাহেব নন। তাই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নামাজ পড়লে আল্লাহ্ খুশি হবেন, আমরা জান্নাতবাসী হব, না পড়লে জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হবে এটা ভাবলেও চিকিৎসাশাস্ত্রে এর প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অপরিসীম।
সবশেষে ইউরোপের এক ব্যক্তির ভ্রমণ কাহিনীর কিছুটা বিবরণ তুলে ধরছি। তিনি লিখেছেন, আমি একদিন নামাজ পড়ছিলাম আর এক ইংরেজ দাঁড়িয়ে তা দেখছিল। আমার নামাজ পড়া শেষ হলে সে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি এখন যেভাবে ব্যায়াম করলে তা নিশ্চয়ই আমার লেখা বই থেকে জেনেছ, কেননা আমি এ পদ্ধতিতে ব্যায়ামের কথা লিখেছি।’ আমি বললাম, আমি তো মুসলমান। আমার ধর্ম ইসলাম আমাকে রোজ পাঁচবার এভাবে ধর্মীয় কাজের আদেশ দিয়েছে। আমি আপনার কোনো ব্যায়ামের বই পড়িনি। সেই ইংরেজ তখন অবাক হয়ে বলল, ‘যে ব্যক্তি প্রতিদিন এ পদ্ধতিতে ব্যায়াম করবে সে কখনো দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল রোগে আক্রান্ত হবে না।’ পরে ওই ইংরেজ ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন বিষয়ে ধারণা নিতে লাগল।
**************************
এ জে ইকবাল আহমদ
দৈনিক নয়া দিগন্ত, ২২ আগষ্ট ২০০৮
*****************************
পাক ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে খেলাফত আন্দোলনের অবদান -আহমদ মনসুর
১৯১৮ সালের নবেম্বরে ১ম বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে। সে বছর অক্টোবরে তুরস্ক মিত্রশক্তির (The Allies i.e British, France and their Allies) কাছে পরাজিত হয়েছিল। কনস্টানটিনোপল তাদের হাতছাড়া হয় এবং তারা যুদ্ধবিরতির আবেদন করে। যুদ্ধ শেষে সেভার্স চুক্তি (Treaty of Severs) অনুসারে বৃটিশ ও অন্যান্য মিত্রশক্তি পরাজিত তুরস্ককে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ইসলামের অধিকর্তা তুরস্কের খলিফার সাম্রাজ্য ব্যবচ্ছেদ ভারতবর্ষের মুসলমানদের মনে গভীর রেখাপাত করে। কারণ, তুরস্ক খেলাফত তৎকালীন বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্ব, একতা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীকরূপে গণ্য ছিল। সে জন্য ভারতের মুসলমানরা খেলাফতের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল এবং সুলতানকে নিজেদের ধর্মীয় নেতারূপে মনে করত। যুদ্ধ শেষে বৃটিশ পূর্ব প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ভারতীয় মুসলমানদের মনে বিদ্রোহের আগুন প্রজ্জ্বলিত করে। ১৯১৫ ও ১৯১৬ সালের সমঝোতা অনুসারে যুদ্ধ চলাকালেই বৃটেন ও ফ্রান্স, ইরাক, সিরিয়া ও প্যালেস্টাইনকে ভাগাভাগি করে নেয়। কিন্তু যুদ্ধের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আরবদের আশ্বাস দেয়া হচ্ছিল যে, আরবদের তুরস্কের স্বৈরাচারী শাসন থেকে মুক্ত করার জন্য এবং তাদের একটা স্বতন্ত্র সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য এ যুদ্ধ পরিচালিত হবে।
যুদ্ধ শেষে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের পক্ষ থেকেও পুনরায় একটা যৌথ ঘোষণাপত্র আরব দেশসমূহে প্রচার করা হয়। তাতে জোর গলায় দাবি করা হয় যে, ‘‘বর্তমান যুদ্ধ কেবলমাত্র জার্মানীর সম্প্রসারণবাদী অভিলাষ থেকে বিশ্ববাসীকে বাঁচানোর জন্য পরিচালিত হয়েছে। এ যুদ্ধকে প্রাচ্যদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত করার কারণ শুধু এই যে, যেসব দেশ দীর্ঘদিন ধরে তুর্কীদের জুলুম-নিপীড়নে পিষ্ট হয়ে আসছে, ফ্রান্স ও ব্রটেন তাদেরকে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করতে ইচ্ছুক। তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, এসব দেশে নির্ভেজাল জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে এবং বাইরের হস্তক্ষেপ থেকে তা পুরোপুরিভাবে মুক্ত থাকবে।’’
এসব ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও আরবরা যখন দেখল সিরিয়ার উপকূলে ফরাসী সৈন্যরা উপস্থিত ও কর্তৃত্বশীল, অপরদিকে ইরাক এবং প্যালেস্টাইনে বৃটিশ ঔপনিবেশিক ঘোষণা ও স্বৈরাচারী শাসনের থাবা বিস্তৃত, তখন তারা বুঝতে পারলো বাস্তবিক পক্ষে তাদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে এবং তুর্কী ও আরবদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে তাদের ভূ-খন্ড আত্মসাৎ করার জন্য চক্রান্ত করা হয়েছে। এজন্য আরব, ইরাক, সিরিয়া ও প্যালেস্টাইনে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করে।
বিশ্বযুদ্ধ থেমে যাওয়ার পরেও বৃটিশের সহায়তায় গ্রীকরা ১৯১৯ সালের মে মাসে বিনা উস্কানিতে পর্যুদস্ত তুরস্কের উপর হামলা চালিয়ে স্মার্থ দখল করে নেয় এবং আনাতোনিয়ার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। তখন তুরস্ক রাজ্য ছিল মুসলিম ভারতের ধর্মীয় নেতৃত্বের আশাভরসার স্থল তথা খিলাফতের প্রাণকেন্দ্র। ভারতীয় মুসলমানরা ভাবলেন, তুরস্কের শক্তি ও স্বাধীনতা ছাড়া খেলাফত টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। মুসলমানরা খিলাফতের সম্মান ও অস্তিত্ব অক্ষুণ্ণ রাখবার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়। মাওলানা মুহম্মদ আলী, তার বড় ভাই মাওলানা শওকত আলী ও মাওলানা আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে বৃটিশের ন্যক্কারজনক ভূমিকার নিন্দা এবং সরকার বিরোধী এক দুর্বার আন্দোলন গড়ে উঠে। এ আন্দোলনই খেলাফত আন্দোলন নামে পরিচিত।
‘এ সময় ড. আনসারীর নেতৃত্বে ‘খেলাফত কমিটি' গঠিত হয়। ১৯১৯ খৃস্টাব্দের ১৭ই অক্টোবর খিলাফত দিবস পালিত হয়। এ কে ফজলুল হক এবং মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে বাংলা খিলাফত আন্দোলন গড়ে ওঠে। ফজলুল হক প্রথম থেকেই এ আন্দোলনের পুরোধানে ছিলেন। ১৯১৯ খৃস্টাব্দের ১৪ নবেম্বর ফজলুল হকের সভাপতিত্বে খিলাফত বৈঠকের প্রথম অধিবেশন দিল্লীতে অনুষ্ঠিত হয়। ঐ বৈঠকে তুরস্কের অখন্ডতা ও খলিফার মর্যাদা রক্ষার দাবি করা হয়। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, এ বিষয়ে বৃটিশ সরকারের প্রতিশ্রুতি না পেলে মুসলমানগণ সরকারের সঙ্গে অসহযোগ নীতি অনুসরণ করবে। একই বছর ডিসেম্বর মাসে মাওলানা শওকত আলীর সভাপতিত্বে খিলাফতের দ্বিতীয় বৈঠক লক্ষ্ণৌতে অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকে তুরস্ক ও খলিফার ব্যাপারে মুসলমানদের মনোভাব জনগণের জন্য বড়লাট ও বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর নিকট একটি প্রতিনিধি দল পাঠানোর প্রস্তাব গৃহীত হয়। ড. আনসারীর নেতৃত্বে মুসলিম ও হিন্দুদের একটি প্রতিনিধি দল ১৯২০ খৃস্টাব্দে জানুয়ারি মাসে বড়লাটের সাথে সাক্ষাৎ করে মুসলমানদের অভিযোগগুলো তুলে ধরেন। কিন্তু বড়লাটের নিকট থেকে সন্তোষজনক উত্তর পাবার ব্যাপারে ব্যর্থ হন। বড়লাট স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন যে, জার্মানীর অনুকূলে অস্ত্র ধারণ করার জন্য তুরস্ককে ফল ভোগ করতেই হবে। ১৯২০ খৃস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতায় আহূত আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে খিলাফত সম্মেলন অসহযোগ আন্দোলনের উপর একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং একটি প্রতিনিধি দলকে লন্ডনে পাঠিয়ে বৃটিশ সরকারের নিকট খিলাফত প্রশ্নটি পেশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাওলানা মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে একটি ডেপুটেশন খিলাফতের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার জন্য প্যারিস ও লন্ডন সফর করে। তারা বৃটিশ সরকার ও মিত্রশক্তির নিকট ভারতীয় মুসলমানদের তীব্র মনোভাব ব্যক্ত করেন। কিন্তু মিত্রশক্তি অথবা বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ কেউই এই ডেপুটেশনকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেননি। ফলে প্রতিনিধিরা ব্যর্থ হয়ে স্বদেশে ফিরে আসেন। এতে ভারতে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন আরও তীব্রতর ও জোরদার হয়। ১৯২০ সালের ১৯ মার্চ ভারতব্যাপী খিলাফতের দাবিতে হরতাল পালিত হয় এবং এর গৌরদীপ্ততাকে পুনর্জীবিত করবার জন্য কমিটি গঠিত হয়। খিলাফত কমিটির বাংলা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি, সেক্রেটারি ও সহ-সেক্রেটারি ছিলেন যথাক্রমে মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ও সৈয়দ মজীদ বকশ। বংগীয় ও কলকাতা খিলাফত কমিটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। খিলাফত বিষয়টি ধর্মীয় অনুভূতি উদ্রেককারী ছিল বলে এতে মুসলমানরাই বহুলাংশে অংশগ্রহণ করে। এতে প্রধানত আলেমরাই নেতৃত্ব দেন। বৃটিশ আমলে আর কোন আন্দোলনে তত বেশি আলেম যোগদান করেছিলেন বলে মনে হয় না।
খিলাফত আন্দোলনে মাওলানা আকরম খাঁর জীবনে বয়ে আনে নব প্রেরণার জোয়ার। এ আন্দোলনকে জোরদার করার উদ্দেশ্যে তিনি মাওলানা মুহম্মদ আলী ও শওকত আলীর সহকর্মীরূপে সারা ভারত সফর করেন। মাওলানা সাহেব খিলাফত আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য ১৯২০ সালের ২১ মে ‘যামানা' নামক একটি উর্দু দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯২১ সালে রাজনৈতিক মতবাদ প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি সেবক নামক অপর একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। সেবক পত্রিকার স্বাধীন ও নির্ভীক মতামত প্রকাশের দরুণ তাকে ১০-১২-২১ ইং তারিখে গ্রেফতার করা হয় এবং কলকাতা আলীপুর জেলে আটক করা হয়।
মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী খিলাফত আন্দোলন পরিচালনায় কেবল সভা-সমিতি করেই ক্ষান্ত হননি। তিনি আনজুমান-এ-উলফা-এ বাংগালার মুখপাত্র ‘আল-ইসলাম' পত্রিকায় কয়েকটি জোরালো প্রবন্ধ লিখে খিলাফত বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা ও অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণের অপরিহার্যতা যুক্তিযুক্তভাবে তুলে ধরেন।
১৯১৯ সালের ১৭ অক্টোবর হরতাল সহকালে প্রথম খিলাফত দিবস উদযাপিত হয়। ২৩-২৪ নবেম্বর একে ফজলুল হকের সভাপতিত্বে দিল্লীতে প্রথম ‘অল ইন্ডিয়া খিলাফত কনফারেন্স' অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে তুরস্কের খিলাফত জোর রক্ষায় ও তুর্কীদের প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় কর্মসূচি গৃহীত হয়। খেলাফতে দাবি মেনে নেয়া না হলে বৃটিশ পণ্য বয়কট এবং অসহযোগ আন্দোলন পরিচালিত হবে বলে ঐ সভায় সিদ্ধান্ত পাস করা হয়।
খিলাফত কমিটি কর্তৃক বৃটিশ পণ্য বয়কট ও অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব গৃহীত হওয়ায় কংগ্রেসের সাথে এর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠে। তাই অনেক হিন্দু নেতা খিলাফতের প্রশ্ন সমর্থন করেন। ১৯১৯ সালের ২৪ নবেম্বর দিল্লীতে হিন্দু-মুসলমানের এক যুক্ত সভায় মহাত্মা গান্ধী ঘোষণা করেন যে, হিন্দুরাও খিলাফত আন্দোলনে সহযোগিতা করবে। অবশ্য এতে মাহাত্মা গান্ধীর উদ্দেশ্য ছিল উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করা, খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা নয়।
খিলাফত আন্দোলনকালে হিন্দু-মুসলমান একত্রে গণআন্দোলন চালালেও মনের মিল হয়নি। মুসলমান খিলাফত আন্দোলন করেছে বহির্বিশ্বের মুসলমানের প্রতি ধর্মীয় সহানুভূতি বশে। কিন্তু গান্ধী খিলাফত আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন আপন ধর্মীয় স্বার্থ বশে। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের দু'জনের পক্ষে খেলাফত একটা কেন্দ্রীয় ব্যাপার- মুহম্মদ আলীর নিকট এটা তাঁর ধর্ম, আর খেলাফতে আত্মদান করলেও সেটা আমার ধর্মের স্বার্থে গোরক্ষার জন্যে আমি মুসলমানদের ছুরিকা হতে গোমাতা রক্ষা করেছি।
১৯২০ সালের অসহযোগ আন্দোলন খিলাফত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মুসলমানদেরই বলিষ্ঠ সংগ্রামী ভূমিকায় সফল হয়েছিল, একথা বিদেশী পর্যবেক্ষকরাও স্বীকার করেন। কিন্তু গান্ধী যখন কংগ্রেসের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন, তখন এটিকে সনাতন ধর্মের রূপ দিয়ে এক ধর্মরাজ্য পাশে ভারতভূমিকে বেঁধে দিয়ে সব শ্রেণীগত ও দ্বনদ্ব সংঘাতের সামঞ্জস্য গ্রহণ করতে সংকল্প গ্রহণ করেন। তারপর কংগ্রেসের অনমনীয় মনোভাব ও মুসলমানদের ন্যায্য দাবির আংশিক ভাগকেও স্বীকার না করার কঠোরতায় মুসলমান ন্যাশনালিস্টদের মোহমুক্তি ঘটে গেল। মুসলমান ন্যাশনালিস্টদের মোহমুক্তি শুরু হয়েছিল অসহযোগ আন্দোলনেই। অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ ছাত্রদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিলাতি পোশাক বর্জনের আহবান জানায়। কংগ্রেস নেতাদের নিকট তখন Education can wait swarj cant ছিল মূলমন্ত্র। বাংলার নেতা এ কে ফজলুল হক অসহযোগের নীতি পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারেননি। তিনি স্কুল-কলেজ বয়কট করাতেও বিরোধী ছিলেন। শিক্ষা পরিত্যাগ করলে তাদের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। সি. আর দাশ ১৯২০ খৃস্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে এক বক্তৃতায় ছাত্রদের স্কুল-কলেজ বয়কট করার পরামর্শ দেন। একই ময়দানে পরের দিন অর্থাৎ ১৩ ডিসেম্বর ফজলুল হক এক বক্তৃতায় ছাত্রদের স্কুল-কলেজ বয়কট না করার পরামর্শ দেন। তিনি তার ভাষণে বলেন, করদাতাদের ৪০ কোটি টাকা শিক্ষার জন্য ব্যয় হয়। স্কুল-কলেজ বয়কটের ব্যাপারে কংগ্রেসের নেতাদের সঙ্গে তার মতান্তর হয়। তিনি এ কারণে অসহযোগের কর্মসূচি মেনে নিতে পারেননি।
শেরে বাংলার কংগ্রেস নেতাদের মতান্তর ঘটার যথেষ্ট কারণ ছিল। অসহযোগ প্রস্তাবে স্কুল-কলেজ বর্জনের নির্দেশ দেয়া হলে বাংলার মুসলমানদের শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। তারা স্কুল কলেজ ছেড়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে অথচ হিন্দু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষাকার্য অব্যাহত থাকে। হাকীম হাবিবুর রহমান তার এক পুস্তিকায় বলেন, ‘‘অসহযোগ আন্দোলনের অন্যান্য দিক সম্পর্কে আমাদের কোন মতবিরোধ ছিল না। আমাদের মতে, শিক্ষা বর্জননীতি ছিল অনর্থক বরং মুসলমানদের জন্য তা ছিল বিষব্য।' মাওলানা আশরাফ আলী থানবী তার এক পুস্তিকায় খিলাফত আন্দোলন সমর্থন করেন। কিন্তু অসহযোগ আন্দোলনকে শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে অবৈধ এবং রাজনৈতিক দিক থেকে মুসলিম জাতির জন্য ক্ষতিকর বলেও উল্লেখ করেন।
খিলাফত আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলন একাকার হয়ে গিয়েছিল এবং কংগ্রেসী হিন্দুরাও তাতে একাত্মতা ঘোষণা করেছিল বলে মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ও ইকবাল এ আন্দোলনে যোগদান করেননি।
১৯২১ খৃস্টাব্দে প্রিন্স অব ওয়েলস বোম্বে ও কলকাতা আগমন করলে উভয় শহরে ধর্মঘট পালিত হয়। সারাদেশে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন চলতে থাকে। মুসলমানেরা বৃটিশ সৈন্যবাহিনী ত্যাগের হুমকি দেয়। সারাদেশে অসহযোগ গণআন্দোলন প্রতিরোধের আন্দোলনে পরিণত হয়। বহু মুসলমান দেশ ছেড়ে আফগানিস্তানে হিজরত করে। শেষ পর্যন্ত গান্ধীর অহিংস স্বরাজ আন্দোলন সীমা লংঘন করে এবং উভয় প্রদেশের চৌরিচোরা নামক স্থানে একদল বিক্ষুব্ধ জনতা থানা আক্রমণ করে ২১ জন সিপাহী ও ১ জন সাব-ইন্সপেক্টরকে জীবন্ত দগ্ধ করে। প্রায় একই সময় মানারোরে মেপিনা কৃষকেরা জমিদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। গান্ধী তার অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলনও এরূপ সহিংসতায় পরিণত হতে দেখে মর্মাহত হন এবং তিনি উপলব্ধি করেন যে, অহিংস সংগ্রামের জন্য দেশবাসী প্রস্তুত নয়। সুতরাং তিনি আন্দোলন বন্ধ করার ডাক দেন। ১৯২২ খৃস্টাব্দে বৃটিশ সরকার গান্ধীকে গ্রেফতার করেন এবং তাকে ছয় মাসের কারাদন্ডে দন্ডিত করেন। ফলে অসহযোগ আন্দোলন ক্রমশ স্তিমিত হয়ে পড়ে।
অসহযোগ আন্দোলনের পরিণতিতে খিলাফত আন্দোলনও ক্রমশ স্তিমিত হয়ে পড়ে। কারণ, ইতোমধ্যে তুরস্কে কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও নবজাগরণের সঞ্চার হয়। ১৯২৪ খৃস্টাব্দে কামাল আতাতুর্ক রাজতন্ত্র ও খেলাফত উঠিয়ে দিয়ে তুরস্কে সাধারণতন্ত্র প্রচলন করেন। এর ফলে বিগত খেলাফত আন্দোলনের যবনিকাপাত ঘটে।
আপাতঃদৃষ্টিতে খিলাফত আন্দোলন ব্যর্থ হলেও এই আন্দোলন সারা ভারতে বৃটিশবিরোধী শক্তিকে উজ্জীবিত করেছিল। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন এই দেশের স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করেছিল এ বিষয়ে কোন দ্বিমত নেই এবং খেলাফত আন্দোলনই রাজনীতি ক্ষেত্রে ভারতীয় মুসলমানদের মনে আত্মবিশ্বাস সঞ্চার করে ও তাদেরকে সর্বপ্রথম সক্রিয় গণআন্দোলনে ও স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তাই আমাদের পাক-ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে খিলাফত আন্দোলনের অবদান ও গুরুত্ব অপরিসীম।
যুদ্ধ শেষে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের পক্ষ থেকেও পুনরায় একটা যৌথ ঘোষণাপত্র আরব দেশসমূহে প্রচার করা হয়। তাতে জোর গলায় দাবি করা হয় যে, ‘‘বর্তমান যুদ্ধ কেবলমাত্র জার্মানীর সম্প্রসারণবাদী অভিলাষ থেকে বিশ্ববাসীকে বাঁচানোর জন্য পরিচালিত হয়েছে। এ যুদ্ধকে প্রাচ্যদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত করার কারণ শুধু এই যে, যেসব দেশ দীর্ঘদিন ধরে তুর্কীদের জুলুম-নিপীড়নে পিষ্ট হয়ে আসছে, ফ্রান্স ও ব্রটেন তাদেরকে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করতে ইচ্ছুক। তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, এসব দেশে নির্ভেজাল জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে এবং বাইরের হস্তক্ষেপ থেকে তা পুরোপুরিভাবে মুক্ত থাকবে।’’
এসব ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও আরবরা যখন দেখল সিরিয়ার উপকূলে ফরাসী সৈন্যরা উপস্থিত ও কর্তৃত্বশীল, অপরদিকে ইরাক এবং প্যালেস্টাইনে বৃটিশ ঔপনিবেশিক ঘোষণা ও স্বৈরাচারী শাসনের থাবা বিস্তৃত, তখন তারা বুঝতে পারলো বাস্তবিক পক্ষে তাদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে এবং তুর্কী ও আরবদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে তাদের ভূ-খন্ড আত্মসাৎ করার জন্য চক্রান্ত করা হয়েছে। এজন্য আরব, ইরাক, সিরিয়া ও প্যালেস্টাইনে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করে।
বিশ্বযুদ্ধ থেমে যাওয়ার পরেও বৃটিশের সহায়তায় গ্রীকরা ১৯১৯ সালের মে মাসে বিনা উস্কানিতে পর্যুদস্ত তুরস্কের উপর হামলা চালিয়ে স্মার্থ দখল করে নেয় এবং আনাতোনিয়ার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। তখন তুরস্ক রাজ্য ছিল মুসলিম ভারতের ধর্মীয় নেতৃত্বের আশাভরসার স্থল তথা খিলাফতের প্রাণকেন্দ্র। ভারতীয় মুসলমানরা ভাবলেন, তুরস্কের শক্তি ও স্বাধীনতা ছাড়া খেলাফত টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। মুসলমানরা খিলাফতের সম্মান ও অস্তিত্ব অক্ষুণ্ণ রাখবার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়। মাওলানা মুহম্মদ আলী, তার বড় ভাই মাওলানা শওকত আলী ও মাওলানা আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে বৃটিশের ন্যক্কারজনক ভূমিকার নিন্দা এবং সরকার বিরোধী এক দুর্বার আন্দোলন গড়ে উঠে। এ আন্দোলনই খেলাফত আন্দোলন নামে পরিচিত।
‘এ সময় ড. আনসারীর নেতৃত্বে ‘খেলাফত কমিটি' গঠিত হয়। ১৯১৯ খৃস্টাব্দের ১৭ই অক্টোবর খিলাফত দিবস পালিত হয়। এ কে ফজলুল হক এবং মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে বাংলা খিলাফত আন্দোলন গড়ে ওঠে। ফজলুল হক প্রথম থেকেই এ আন্দোলনের পুরোধানে ছিলেন। ১৯১৯ খৃস্টাব্দের ১৪ নবেম্বর ফজলুল হকের সভাপতিত্বে খিলাফত বৈঠকের প্রথম অধিবেশন দিল্লীতে অনুষ্ঠিত হয়। ঐ বৈঠকে তুরস্কের অখন্ডতা ও খলিফার মর্যাদা রক্ষার দাবি করা হয়। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, এ বিষয়ে বৃটিশ সরকারের প্রতিশ্রুতি না পেলে মুসলমানগণ সরকারের সঙ্গে অসহযোগ নীতি অনুসরণ করবে। একই বছর ডিসেম্বর মাসে মাওলানা শওকত আলীর সভাপতিত্বে খিলাফতের দ্বিতীয় বৈঠক লক্ষ্ণৌতে অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকে তুরস্ক ও খলিফার ব্যাপারে মুসলমানদের মনোভাব জনগণের জন্য বড়লাট ও বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর নিকট একটি প্রতিনিধি দল পাঠানোর প্রস্তাব গৃহীত হয়। ড. আনসারীর নেতৃত্বে মুসলিম ও হিন্দুদের একটি প্রতিনিধি দল ১৯২০ খৃস্টাব্দে জানুয়ারি মাসে বড়লাটের সাথে সাক্ষাৎ করে মুসলমানদের অভিযোগগুলো তুলে ধরেন। কিন্তু বড়লাটের নিকট থেকে সন্তোষজনক উত্তর পাবার ব্যাপারে ব্যর্থ হন। বড়লাট স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন যে, জার্মানীর অনুকূলে অস্ত্র ধারণ করার জন্য তুরস্ককে ফল ভোগ করতেই হবে। ১৯২০ খৃস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতায় আহূত আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে খিলাফত সম্মেলন অসহযোগ আন্দোলনের উপর একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং একটি প্রতিনিধি দলকে লন্ডনে পাঠিয়ে বৃটিশ সরকারের নিকট খিলাফত প্রশ্নটি পেশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাওলানা মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে একটি ডেপুটেশন খিলাফতের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার জন্য প্যারিস ও লন্ডন সফর করে। তারা বৃটিশ সরকার ও মিত্রশক্তির নিকট ভারতীয় মুসলমানদের তীব্র মনোভাব ব্যক্ত করেন। কিন্তু মিত্রশক্তি অথবা বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ কেউই এই ডেপুটেশনকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেননি। ফলে প্রতিনিধিরা ব্যর্থ হয়ে স্বদেশে ফিরে আসেন। এতে ভারতে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন আরও তীব্রতর ও জোরদার হয়। ১৯২০ সালের ১৯ মার্চ ভারতব্যাপী খিলাফতের দাবিতে হরতাল পালিত হয় এবং এর গৌরদীপ্ততাকে পুনর্জীবিত করবার জন্য কমিটি গঠিত হয়। খিলাফত কমিটির বাংলা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি, সেক্রেটারি ও সহ-সেক্রেটারি ছিলেন যথাক্রমে মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ও সৈয়দ মজীদ বকশ। বংগীয় ও কলকাতা খিলাফত কমিটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। খিলাফত বিষয়টি ধর্মীয় অনুভূতি উদ্রেককারী ছিল বলে এতে মুসলমানরাই বহুলাংশে অংশগ্রহণ করে। এতে প্রধানত আলেমরাই নেতৃত্ব দেন। বৃটিশ আমলে আর কোন আন্দোলনে তত বেশি আলেম যোগদান করেছিলেন বলে মনে হয় না।
খিলাফত আন্দোলনে মাওলানা আকরম খাঁর জীবনে বয়ে আনে নব প্রেরণার জোয়ার। এ আন্দোলনকে জোরদার করার উদ্দেশ্যে তিনি মাওলানা মুহম্মদ আলী ও শওকত আলীর সহকর্মীরূপে সারা ভারত সফর করেন। মাওলানা সাহেব খিলাফত আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য ১৯২০ সালের ২১ মে ‘যামানা' নামক একটি উর্দু দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯২১ সালে রাজনৈতিক মতবাদ প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি সেবক নামক অপর একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। সেবক পত্রিকার স্বাধীন ও নির্ভীক মতামত প্রকাশের দরুণ তাকে ১০-১২-২১ ইং তারিখে গ্রেফতার করা হয় এবং কলকাতা আলীপুর জেলে আটক করা হয়।
মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী খিলাফত আন্দোলন পরিচালনায় কেবল সভা-সমিতি করেই ক্ষান্ত হননি। তিনি আনজুমান-এ-উলফা-এ বাংগালার মুখপাত্র ‘আল-ইসলাম' পত্রিকায় কয়েকটি জোরালো প্রবন্ধ লিখে খিলাফত বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা ও অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণের অপরিহার্যতা যুক্তিযুক্তভাবে তুলে ধরেন।
১৯১৯ সালের ১৭ অক্টোবর হরতাল সহকালে প্রথম খিলাফত দিবস উদযাপিত হয়। ২৩-২৪ নবেম্বর একে ফজলুল হকের সভাপতিত্বে দিল্লীতে প্রথম ‘অল ইন্ডিয়া খিলাফত কনফারেন্স' অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে তুরস্কের খিলাফত জোর রক্ষায় ও তুর্কীদের প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় কর্মসূচি গৃহীত হয়। খেলাফতে দাবি মেনে নেয়া না হলে বৃটিশ পণ্য বয়কট এবং অসহযোগ আন্দোলন পরিচালিত হবে বলে ঐ সভায় সিদ্ধান্ত পাস করা হয়।
খিলাফত কমিটি কর্তৃক বৃটিশ পণ্য বয়কট ও অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব গৃহীত হওয়ায় কংগ্রেসের সাথে এর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠে। তাই অনেক হিন্দু নেতা খিলাফতের প্রশ্ন সমর্থন করেন। ১৯১৯ সালের ২৪ নবেম্বর দিল্লীতে হিন্দু-মুসলমানের এক যুক্ত সভায় মহাত্মা গান্ধী ঘোষণা করেন যে, হিন্দুরাও খিলাফত আন্দোলনে সহযোগিতা করবে। অবশ্য এতে মাহাত্মা গান্ধীর উদ্দেশ্য ছিল উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করা, খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা নয়।
খিলাফত আন্দোলনকালে হিন্দু-মুসলমান একত্রে গণআন্দোলন চালালেও মনের মিল হয়নি। মুসলমান খিলাফত আন্দোলন করেছে বহির্বিশ্বের মুসলমানের প্রতি ধর্মীয় সহানুভূতি বশে। কিন্তু গান্ধী খিলাফত আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন আপন ধর্মীয় স্বার্থ বশে। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের দু'জনের পক্ষে খেলাফত একটা কেন্দ্রীয় ব্যাপার- মুহম্মদ আলীর নিকট এটা তাঁর ধর্ম, আর খেলাফতে আত্মদান করলেও সেটা আমার ধর্মের স্বার্থে গোরক্ষার জন্যে আমি মুসলমানদের ছুরিকা হতে গোমাতা রক্ষা করেছি।
১৯২০ সালের অসহযোগ আন্দোলন খিলাফত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মুসলমানদেরই বলিষ্ঠ সংগ্রামী ভূমিকায় সফল হয়েছিল, একথা বিদেশী পর্যবেক্ষকরাও স্বীকার করেন। কিন্তু গান্ধী যখন কংগ্রেসের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন, তখন এটিকে সনাতন ধর্মের রূপ দিয়ে এক ধর্মরাজ্য পাশে ভারতভূমিকে বেঁধে দিয়ে সব শ্রেণীগত ও দ্বনদ্ব সংঘাতের সামঞ্জস্য গ্রহণ করতে সংকল্প গ্রহণ করেন। তারপর কংগ্রেসের অনমনীয় মনোভাব ও মুসলমানদের ন্যায্য দাবির আংশিক ভাগকেও স্বীকার না করার কঠোরতায় মুসলমান ন্যাশনালিস্টদের মোহমুক্তি ঘটে গেল। মুসলমান ন্যাশনালিস্টদের মোহমুক্তি শুরু হয়েছিল অসহযোগ আন্দোলনেই। অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ ছাত্রদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিলাতি পোশাক বর্জনের আহবান জানায়। কংগ্রেস নেতাদের নিকট তখন Education can wait swarj cant ছিল মূলমন্ত্র। বাংলার নেতা এ কে ফজলুল হক অসহযোগের নীতি পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারেননি। তিনি স্কুল-কলেজ বয়কট করাতেও বিরোধী ছিলেন। শিক্ষা পরিত্যাগ করলে তাদের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। সি. আর দাশ ১৯২০ খৃস্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে এক বক্তৃতায় ছাত্রদের স্কুল-কলেজ বয়কট করার পরামর্শ দেন। একই ময়দানে পরের দিন অর্থাৎ ১৩ ডিসেম্বর ফজলুল হক এক বক্তৃতায় ছাত্রদের স্কুল-কলেজ বয়কট না করার পরামর্শ দেন। তিনি তার ভাষণে বলেন, করদাতাদের ৪০ কোটি টাকা শিক্ষার জন্য ব্যয় হয়। স্কুল-কলেজ বয়কটের ব্যাপারে কংগ্রেসের নেতাদের সঙ্গে তার মতান্তর হয়। তিনি এ কারণে অসহযোগের কর্মসূচি মেনে নিতে পারেননি।
শেরে বাংলার কংগ্রেস নেতাদের মতান্তর ঘটার যথেষ্ট কারণ ছিল। অসহযোগ প্রস্তাবে স্কুল-কলেজ বর্জনের নির্দেশ দেয়া হলে বাংলার মুসলমানদের শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। তারা স্কুল কলেজ ছেড়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে অথচ হিন্দু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষাকার্য অব্যাহত থাকে। হাকীম হাবিবুর রহমান তার এক পুস্তিকায় বলেন, ‘‘অসহযোগ আন্দোলনের অন্যান্য দিক সম্পর্কে আমাদের কোন মতবিরোধ ছিল না। আমাদের মতে, শিক্ষা বর্জননীতি ছিল অনর্থক বরং মুসলমানদের জন্য তা ছিল বিষব্য।' মাওলানা আশরাফ আলী থানবী তার এক পুস্তিকায় খিলাফত আন্দোলন সমর্থন করেন। কিন্তু অসহযোগ আন্দোলনকে শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে অবৈধ এবং রাজনৈতিক দিক থেকে মুসলিম জাতির জন্য ক্ষতিকর বলেও উল্লেখ করেন।
খিলাফত আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলন একাকার হয়ে গিয়েছিল এবং কংগ্রেসী হিন্দুরাও তাতে একাত্মতা ঘোষণা করেছিল বলে মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ও ইকবাল এ আন্দোলনে যোগদান করেননি।
১৯২১ খৃস্টাব্দে প্রিন্স অব ওয়েলস বোম্বে ও কলকাতা আগমন করলে উভয় শহরে ধর্মঘট পালিত হয়। সারাদেশে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন চলতে থাকে। মুসলমানেরা বৃটিশ সৈন্যবাহিনী ত্যাগের হুমকি দেয়। সারাদেশে অসহযোগ গণআন্দোলন প্রতিরোধের আন্দোলনে পরিণত হয়। বহু মুসলমান দেশ ছেড়ে আফগানিস্তানে হিজরত করে। শেষ পর্যন্ত গান্ধীর অহিংস স্বরাজ আন্দোলন সীমা লংঘন করে এবং উভয় প্রদেশের চৌরিচোরা নামক স্থানে একদল বিক্ষুব্ধ জনতা থানা আক্রমণ করে ২১ জন সিপাহী ও ১ জন সাব-ইন্সপেক্টরকে জীবন্ত দগ্ধ করে। প্রায় একই সময় মানারোরে মেপিনা কৃষকেরা জমিদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। গান্ধী তার অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলনও এরূপ সহিংসতায় পরিণত হতে দেখে মর্মাহত হন এবং তিনি উপলব্ধি করেন যে, অহিংস সংগ্রামের জন্য দেশবাসী প্রস্তুত নয়। সুতরাং তিনি আন্দোলন বন্ধ করার ডাক দেন। ১৯২২ খৃস্টাব্দে বৃটিশ সরকার গান্ধীকে গ্রেফতার করেন এবং তাকে ছয় মাসের কারাদন্ডে দন্ডিত করেন। ফলে অসহযোগ আন্দোলন ক্রমশ স্তিমিত হয়ে পড়ে।
অসহযোগ আন্দোলনের পরিণতিতে খিলাফত আন্দোলনও ক্রমশ স্তিমিত হয়ে পড়ে। কারণ, ইতোমধ্যে তুরস্কে কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও নবজাগরণের সঞ্চার হয়। ১৯২৪ খৃস্টাব্দে কামাল আতাতুর্ক রাজতন্ত্র ও খেলাফত উঠিয়ে দিয়ে তুরস্কে সাধারণতন্ত্র প্রচলন করেন। এর ফলে বিগত খেলাফত আন্দোলনের যবনিকাপাত ঘটে।
আপাতঃদৃষ্টিতে খিলাফত আন্দোলন ব্যর্থ হলেও এই আন্দোলন সারা ভারতে বৃটিশবিরোধী শক্তিকে উজ্জীবিত করেছিল। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন এই দেশের স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করেছিল এ বিষয়ে কোন দ্বিমত নেই এবং খেলাফত আন্দোলনই রাজনীতি ক্ষেত্রে ভারতীয় মুসলমানদের মনে আত্মবিশ্বাস সঞ্চার করে ও তাদেরকে সর্বপ্রথম সক্রিয় গণআন্দোলনে ও স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তাই আমাদের পাক-ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে খিলাফত আন্দোলনের অবদান ও গুরুত্ব অপরিসীম।