ইসলাম ধর্মে যে পাঁচটি কাজকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে তার মধ্যে নামাজ অন্যতম। এটা এমন একটি ইবাদত যা মানুষকে মহান আল্লাহপাকের কাছাকাছিই করে না, শারীরিক কল্যাণও সাধিত হয়। আমাদের প্রিয় নবী সাঃ বলেছেন, ‘পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ হলো কারো বাড়ির পার্শ্ব দিয়ে প্রবাহিত স্রোতধারার মতো। কোনো ব্যক্তি তাতে পাঁচবার গোসল করলে যেমন গায়ে ময়লা থাকতে পারে না, তেমনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও মানুষকে পবিত্র করে দেয়।’ আর আল্লাহপাক পবিত্র কালামে পাকে ৮২ বার নামাজ কায়েমের কথা বলেছেন। নামাজের ফলে শুধু সওয়াব অর্জনই হয় না দৈহিকভাবেও অনেক উপকার পাওয়া যায়। নামাজ উত্তম ব্যায়াম। অলসতা ও বিষণ্নতার যুগে নামাজই একমাত্র ব্যায়াম যা দ্বারা ইহকালীন বেশিরভাগ ব্যথার উপশম হয়। সঠিক পদ্ধতিতে নামাজ আদায় করলে অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেমন মস্তিষ্ক, গর্দান, সিনা ও ফুসফুস সতেজ থাকে। এর ফলে হায়াত বৃদ্ধি পায়।

পবিত্র ধর্ম ইসলাম কতটা বৈজ্ঞানিকভাবে সমৃদ্ধ তা বোঝা যায় নামাজের সময়সূচি দ্বারা। মানুষ সারারাত শুয়ে ঘুমায়, ফলে বিভিন্ন অঙ্গ নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তাই রাখা হয়েছে তাহাজুদ্দের ও ফজরের নামাজ। অতঃপর কিছুক্ষণ বিরতি নাস্তার জন্য। পরে এশরাক্‌ ও চাশ্‌তের নামাজ। কাজে কর্মে মানুষকে ব্যস্ত থাকতে হয় বলে লম্বা বিরতির পরে জোহরের নামাজ রাখা হয়েছে। রাতে এশার নামাজটা বিতর ও হাল্‌কি নফলসহ দীর্ঘ করা হয়েছে। কারণ অনেকেই হজমের সুবিধার জন্য এশার নামাজের আগেই পানাহার সেরে ফেলেন। কাজেই আল্লাহ কত সুপরিকল্পিতভাবে নামাজের সময় বেঁধে দিয়েছেন ভাবতে অবাক লাগে।

পবিত্র ধর্ম ইসলাম প্রায় ১৫০০ বছর আগে যে পদ্ধতি উপহার দিয়েছিল আজ তা উত্তম শরীরচর্চা হিসেবে প্রমাণিত। একজন বিখ্যাত চিকিৎসক স্নায়ুর দুর্বলতা, জোড়ায় জোড়ায় ব্যথা এবং অন্যান্য মাংসপেশীর ব্যাধির জন্য অনেক চিকিৎসা করিয়েছেন। পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি। তারপর নামাজের দ্বারা ভালো হয়ে উঠেছেন। (সূত্রঃ প্রফেসরস্‌ কারেন্ট এফেয়ার্স) তিনি এক পর্যায়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ওষুধ সেবন পরিত্যাগ করেছিলেন এবং নিয়মিত নামাজ আদায় দ্বারা সুস্থ হলেন। এ ঘটনা থেকে ওই চিকিৎসক শিক্ষা নিলেন এবং তার প্রত্যেক মুসলিম রোগীকে যারা, চলাফেরায় সক্ষম তাদের নামাজ পড়তে বলেন। নামাজের প্রতিটি রুকু ও সিজদা সঠিকভাবে আদায় করে তার বেশিরভাগ রোগী আরোগ্য লাভ করতে লাগল।

এরপর ডাক্তার সাহেব নামাজ দ্বারা যেসব রোগ নিরাময় হয় তার একটি তালিকা তৈরি করলেন। নামাজ দ্বারা আটটি রোগ থেকে মুক্তি লাভ করা যায়। সেগুলো হলো ১. মানসিক রোগ ২. স্নায়ুবিক রোগ যা বর্তমানে বেড়ে গেছে আর দেশে ভালো নিওরোলজিস্টের খুব সঙ্কট ৩. অস্থিরতা, ডিপ্রেশন ৪. মনস্তাত্ত্বিক রোগ ৫. হার্টের রোগ ৬. জোড়ায় ব্যথা ৭. ইউরিক অ্যাসিড থেকে সৃষ্ট রোগ এবং ৮. পাকস্থলী ও আলসারের রোগ। এ তালিকা তৈরি করেছেন একজন বিখ্যাত ফিজিশিয়ান, কোনো মৌলভী সাহেব নন। তাই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নামাজ পড়লে আল্লাহ্‌ খুশি হবেন, আমরা জান্নাতবাসী হব, না পড়লে জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হবে এটা ভাবলেও চিকিৎসাশাস্ত্রে এর প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অপরিসীম।
সবশেষে ইউরোপের এক ব্যক্তির ভ্রমণ কাহিনীর কিছুটা বিবরণ তুলে ধরছি। তিনি লিখেছেন, আমি একদিন নামাজ পড়ছিলাম আর এক ইংরেজ দাঁড়িয়ে তা দেখছিল। আমার নামাজ পড়া শেষ হলে সে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি এখন যেভাবে ব্যায়াম করলে তা নিশ্চয়ই আমার লেখা বই থেকে জেনেছ, কেননা আমি এ পদ্ধতিতে ব্যায়ামের কথা লিখেছি।’ আমি বললাম, আমি তো মুসলমান। আমার ধর্ম ইসলাম আমাকে রোজ পাঁচবার এভাবে ধর্মীয় কাজের আদেশ দিয়েছে। আমি আপনার কোনো ব্যায়ামের বই পড়িনি। সেই ইংরেজ তখন অবাক হয়ে বলল, ‘যে ব্যক্তি প্রতিদিন এ পদ্ধতিতে ব্যায়াম করবে সে কখনো দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল রোগে আক্রান্ত হবে না।’ পরে ওই ইংরেজ ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন বিষয়ে ধারণা নিতে লাগল।

**************************
এ জে ইকবাল আহমদ
দৈনিক নয়া দিগন্ত, ২২ আগষ্ট ২০০৮

*****************************
পাক ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে খেলাফত আন্দোলনের অবদান -আহমদ মনসুর
১৯১৮ সালের নবেম্বরে ১ম বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে। সে বছর অক্টোবরে তুরস্ক মিত্রশক্তির (The Allies i.e British, France and their Allies) কাছে পরাজিত হয়েছিল। কনস্টানটিনোপল তাদের হাতছাড়া হয় এবং তারা যুদ্ধবিরতির আবেদন করে। যুদ্ধ শেষে সেভার্স চুক্তি (Treaty of Severs) অনুসারে বৃটিশ ও অন্যান্য মিত্রশক্তি পরাজিত তুরস্ককে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ইসলামের অধিকর্তা তুরস্কের খলিফার সাম্রাজ্য ব্যবচ্ছেদ ভারতবর্ষের মুসলমানদের মনে গভীর রেখাপাত করে। কারণ, তুরস্ক খেলাফত তৎকালীন বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্ব, একতা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীকরূপে গণ্য ছিল। সে জন্য ভারতের মুসলমানরা খেলাফতের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল এবং সুলতানকে নিজেদের ধর্মীয় নেতারূপে মনে করত। যুদ্ধ শেষে বৃটিশ পূর্ব প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ভারতীয় মুসলমানদের মনে বিদ্রোহের আগুন প্রজ্জ্বলিত করে। ১৯১৫ ও ১৯১৬ সালের সমঝোতা অনুসারে যুদ্ধ চলাকালেই বৃটেন ও ফ্রান্স, ইরাক, সিরিয়া ও প্যালেস্টাইনকে ভাগাভাগি করে নেয়। কিন্তু যুদ্ধের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আরবদের আশ্বাস দেয়া হচ্ছিল যে, আরবদের তুরস্কের স্বৈরাচারী শাসন থেকে মুক্ত করার জন্য এবং তাদের একটা স্বতন্ত্র সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য এ যুদ্ধ পরিচালিত হবে।
যুদ্ধ শেষে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের পক্ষ থেকেও পুনরায় একটা যৌথ ঘোষণাপত্র আরব দেশসমূহে প্রচার করা হয়। তাতে জোর গলায় দাবি করা হয় যে, ‘‘বর্তমান যুদ্ধ কেবলমাত্র জার্মানীর সম্প্রসারণবাদী অভিলাষ থেকে বিশ্ববাসীকে বাঁচানোর জন্য পরিচালিত হয়েছে। এ যুদ্ধকে প্রাচ্যদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত করার কারণ শুধু এই যে, যেসব দেশ দীর্ঘদিন ধরে তুর্কীদের জুলুম-নিপীড়নে পিষ্ট হয়ে আসছে, ফ্রান্স ও ব্রটেন তাদেরকে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করতে ইচ্ছুক। তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, এসব দেশে নির্ভেজাল জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে এবং বাইরের হস্তক্ষেপ থেকে তা পুরোপুরিভাবে মুক্ত থাকবে।’’
এসব ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও আরবরা যখন দেখল সিরিয়ার উপকূলে ফরাসী সৈন্যরা উপস্থিত ও কর্তৃত্বশীল, অপরদিকে ইরাক এবং প্যালেস্টাইনে বৃটিশ ঔপনিবেশিক ঘোষণা ও স্বৈরাচারী শাসনের থাবা বিস্তৃত, তখন তারা বুঝতে পারলো বাস্তবিক পক্ষে তাদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে এবং তুর্কী ও আরবদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে তাদের ভূ-খন্ড আত্মসাৎ করার জন্য চক্রান্ত করা হয়েছে। এজন্য আরব, ইরাক, সিরিয়া ও প্যালেস্টাইনে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করে।
বিশ্বযুদ্ধ থেমে যাওয়ার পরেও বৃটিশের সহায়তায় গ্রীকরা ১৯১৯ সালের মে মাসে বিনা উস্কানিতে পর্যুদস্ত তুরস্কের উপর হামলা চালিয়ে স্মার্থ দখল করে নেয় এবং আনাতোনিয়ার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। তখন তুরস্ক রাজ্য ছিল মুসলিম ভারতের ধর্মীয় নেতৃত্বের আশাভরসার স্থল তথা খিলাফতের প্রাণকেন্দ্র। ভারতীয় মুসলমানরা ভাবলেন, তুরস্কের শক্তি ও স্বাধীনতা ছাড়া খেলাফত টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। মুসলমানরা খিলাফতের সম্মান ও অস্তিত্ব অক্ষুণ্ণ রাখবার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়। মাওলানা মুহম্মদ আলী, তার বড় ভাই মাওলানা শওকত আলী ও মাওলানা আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে বৃটিশের ন্যক্কারজনক ভূমিকার নিন্দা এবং সরকার বিরোধী এক দুর্বার আন্দোলন গড়ে উঠে। এ আন্দোলনই খেলাফত আন্দোলন নামে পরিচিত।
‘এ সময় ড. আনসারীর নেতৃত্বে ‘খেলাফত কমিটি' গঠিত হয়। ১৯১৯ খৃস্টাব্দের ১৭ই অক্টোবর খিলাফত দিবস পালিত হয়। এ কে ফজলুল হক এবং মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে বাংলা খিলাফত আন্দোলন গড়ে ওঠে। ফজলুল হক প্রথম থেকেই এ আন্দোলনের পুরোধানে ছিলেন। ১৯১৯ খৃস্টাব্দের ১৪ নবেম্বর ফজলুল হকের সভাপতিত্বে খিলাফত বৈঠকের প্রথম অধিবেশন দিল্লীতে অনুষ্ঠিত হয়। ঐ বৈঠকে তুরস্কের অখন্ডতা ও খলিফার মর্যাদা রক্ষার দাবি করা হয়। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, এ বিষয়ে বৃটিশ সরকারের প্রতিশ্রুতি না পেলে মুসলমানগণ সরকারের সঙ্গে অসহযোগ নীতি অনুসরণ করবে। একই বছর ডিসেম্বর মাসে মাওলানা শওকত আলীর সভাপতিত্বে খিলাফতের দ্বিতীয় বৈঠক লক্ষ্ণৌতে অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকে তুরস্ক ও খলিফার ব্যাপারে মুসলমানদের মনোভাব জনগণের জন্য বড়লাট ও বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর নিকট একটি প্রতিনিধি দল পাঠানোর প্রস্তাব গৃহীত হয়। ড. আনসারীর নেতৃত্বে মুসলিম ও হিন্দুদের একটি প্রতিনিধি দল ১৯২০ খৃস্টাব্দে জানুয়ারি মাসে বড়লাটের সাথে সাক্ষাৎ করে মুসলমানদের অভিযোগগুলো তুলে ধরেন। কিন্তু বড়লাটের নিকট থেকে সন্তোষজনক উত্তর পাবার ব্যাপারে ব্যর্থ হন। বড়লাট স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন যে, জার্মানীর অনুকূলে অস্ত্র ধারণ করার জন্য তুরস্ককে ফল ভোগ করতেই হবে। ১৯২০ খৃস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতায় আহূত আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে খিলাফত সম্মেলন অসহযোগ আন্দোলনের উপর একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং একটি প্রতিনিধি দলকে লন্ডনে পাঠিয়ে বৃটিশ সরকারের নিকট খিলাফত প্রশ্নটি পেশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাওলানা মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে একটি ডেপুটেশন খিলাফতের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার জন্য প্যারিস ও লন্ডন সফর করে। তারা বৃটিশ সরকার ও মিত্রশক্তির নিকট ভারতীয় মুসলমানদের তীব্র মনোভাব ব্যক্ত করেন। কিন্তু মিত্রশক্তি অথবা বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ কেউই এই ডেপুটেশনকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেননি। ফলে প্রতিনিধিরা ব্যর্থ হয়ে স্বদেশে ফিরে আসেন। এতে ভারতে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন আরও তীব্রতর ও জোরদার হয়। ১৯২০ সালের ১৯ মার্চ ভারতব্যাপী খিলাফতের দাবিতে হরতাল পালিত হয় এবং এর গৌরদীপ্ততাকে পুনর্জীবিত করবার জন্য কমিটি গঠিত হয়। খিলাফত কমিটির বাংলা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি, সেক্রেটারি ও সহ-সেক্রেটারি ছিলেন যথাক্রমে মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ও সৈয়দ মজীদ বকশ। বংগীয় ও কলকাতা খিলাফত কমিটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। খিলাফত বিষয়টি ধর্মীয় অনুভূতি উদ্রেককারী ছিল বলে এতে মুসলমানরাই বহুলাংশে অংশগ্রহণ করে। এতে প্রধানত আলেমরাই নেতৃত্ব দেন। বৃটিশ আমলে আর কোন আন্দোলনে তত বেশি আলেম যোগদান করেছিলেন বলে মনে হয় না।
খিলাফত আন্দোলনে মাওলানা আকরম খাঁর জীবনে বয়ে আনে নব প্রেরণার জোয়ার। এ আন্দোলনকে জোরদার করার উদ্দেশ্যে তিনি মাওলানা মুহম্মদ আলী ও শওকত আলীর সহকর্মীরূপে সারা ভারত সফর করেন। মাওলানা সাহেব খিলাফত আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য ১৯২০ সালের ২১ মে ‘যামানা' নামক একটি উর্দু দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯২১ সালে রাজনৈতিক মতবাদ প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি সেবক নামক অপর একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। সেবক পত্রিকার স্বাধীন ও নির্ভীক মতামত প্রকাশের দরুণ তাকে ১০-১২-২১ ইং তারিখে গ্রেফতার করা হয় এবং কলকাতা আলীপুর জেলে আটক করা হয়।
মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী খিলাফত আন্দোলন পরিচালনায় কেবল সভা-সমিতি করেই ক্ষান্ত হননি। তিনি আনজুমান-এ-উলফা-এ বাংগালার মুখপাত্র ‘আল-ইসলাম' পত্রিকায় কয়েকটি জোরালো প্রবন্ধ লিখে খিলাফত বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা ও অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণের অপরিহার্যতা যুক্তিযুক্তভাবে তুলে ধরেন।
১৯১৯ সালের ১৭ অক্টোবর হরতাল সহকালে প্রথম খিলাফত দিবস উদযাপিত হয়। ২৩-২৪ নবেম্বর একে ফজলুল হকের সভাপতিত্বে দিল্লীতে প্রথম ‘অল ইন্ডিয়া খিলাফত কনফারেন্স' অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে তুরস্কের খিলাফত জোর রক্ষায় ও তুর্কীদের প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় কর্মসূচি গৃহীত হয়। খেলাফতে দাবি মেনে নেয়া না হলে বৃটিশ পণ্য বয়কট এবং অসহযোগ আন্দোলন পরিচালিত হবে বলে ঐ সভায় সিদ্ধান্ত পাস করা হয়।
খিলাফত কমিটি কর্তৃক বৃটিশ পণ্য বয়কট ও অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব গৃহীত হওয়ায় কংগ্রেসের সাথে এর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠে। তাই অনেক হিন্দু নেতা খিলাফতের প্রশ্ন সমর্থন করেন। ১৯১৯ সালের ২৪ নবেম্বর দিল্লীতে হিন্দু-মুসলমানের এক যুক্ত সভায় মহাত্মা গান্ধী ঘোষণা করেন যে, হিন্দুরাও খিলাফত আন্দোলনে সহযোগিতা করবে। অবশ্য এতে মাহাত্মা গান্ধীর উদ্দেশ্য ছিল উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করা, খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা নয়।
খিলাফত আন্দোলনকালে হিন্দু-মুসলমান একত্রে গণআন্দোলন চালালেও মনের মিল হয়নি। মুসলমান খিলাফত আন্দোলন করেছে বহির্বিশ্বের মুসলমানের প্রতি ধর্মীয় সহানুভূতি বশে। কিন্তু গান্ধী খিলাফত আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন আপন ধর্মীয় স্বার্থ বশে। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের দু'জনের পক্ষে খেলাফত একটা কেন্দ্রীয় ব্যাপার- মুহম্মদ আলীর নিকট এটা তাঁর ধর্ম, আর খেলাফতে আত্মদান করলেও সেটা আমার ধর্মের স্বার্থে গোরক্ষার জন্যে আমি মুসলমানদের ছুরিকা হতে গোমাতা রক্ষা করেছি।
১৯২০ সালের অসহযোগ আন্দোলন খিলাফত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মুসলমানদেরই বলিষ্ঠ সংগ্রামী ভূমিকায় সফল হয়েছিল, একথা বিদেশী পর্যবেক্ষকরাও স্বীকার করেন। কিন্তু গান্ধী যখন কংগ্রেসের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন, তখন এটিকে সনাতন ধর্মের রূপ দিয়ে এক ধর্মরাজ্য পাশে ভারতভূমিকে বেঁধে দিয়ে সব শ্রেণীগত ও দ্বনদ্ব সংঘাতের সামঞ্জস্য গ্রহণ করতে সংকল্প গ্রহণ করেন। তারপর কংগ্রেসের অনমনীয় মনোভাব ও মুসলমানদের ন্যায্য দাবির আংশিক ভাগকেও স্বীকার না করার কঠোরতায় মুসলমান ন্যাশনালিস্টদের মোহমুক্তি ঘটে গেল। মুসলমান ন্যাশনালিস্টদের মোহমুক্তি শুরু হয়েছিল অসহযোগ আন্দোলনেই। অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ ছাত্রদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিলাতি পোশাক বর্জনের আহবান জানায়। কংগ্রেস নেতাদের নিকট তখন Education can wait swarj cant ছিল মূলমন্ত্র। বাংলার নেতা এ কে ফজলুল হক অসহযোগের নীতি পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারেননি। তিনি স্কুল-কলেজ বয়কট করাতেও বিরোধী ছিলেন। শিক্ষা পরিত্যাগ করলে তাদের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। সি. আর দাশ ১৯২০ খৃস্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে এক বক্তৃতায় ছাত্রদের স্কুল-কলেজ বয়কট করার পরামর্শ দেন। একই ময়দানে পরের দিন অর্থাৎ ১৩ ডিসেম্বর ফজলুল হক এক বক্তৃতায় ছাত্রদের স্কুল-কলেজ বয়কট না করার পরামর্শ দেন। তিনি তার ভাষণে বলেন, করদাতাদের ৪০ কোটি টাকা শিক্ষার জন্য ব্যয় হয়। স্কুল-কলেজ বয়কটের ব্যাপারে কংগ্রেসের নেতাদের সঙ্গে তার মতান্তর হয়। তিনি এ কারণে অসহযোগের কর্মসূচি মেনে নিতে পারেননি।
শেরে বাংলার কংগ্রেস নেতাদের মতান্তর ঘটার যথেষ্ট কারণ ছিল। অসহযোগ প্রস্তাবে স্কুল-কলেজ বর্জনের নির্দেশ দেয়া হলে বাংলার মুসলমানদের শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। তারা স্কুল কলেজ ছেড়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে অথচ হিন্দু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষাকার্য অব্যাহত থাকে। হাকীম হাবিবুর রহমান তার এক পুস্তিকায় বলেন, ‘‘অসহযোগ আন্দোলনের অন্যান্য দিক সম্পর্কে আমাদের কোন মতবিরোধ ছিল না। আমাদের মতে, শিক্ষা বর্জননীতি ছিল অনর্থক বরং মুসলমানদের জন্য তা ছিল বিষব্য।' মাওলানা আশরাফ আলী থানবী তার এক পুস্তিকায় খিলাফত আন্দোলন সমর্থন করেন। কিন্তু অসহযোগ আন্দোলনকে শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে অবৈধ এবং রাজনৈতিক দিক থেকে মুসলিম জাতির জন্য ক্ষতিকর বলেও উল্লেখ করেন।
খিলাফত আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলন একাকার হয়ে গিয়েছিল এবং কংগ্রেসী হিন্দুরাও তাতে একাত্মতা ঘোষণা করেছিল বলে মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ও ইকবাল এ আন্দোলনে যোগদান করেননি।
১৯২১ খৃস্টাব্দে প্রিন্স অব ওয়েলস বোম্বে ও কলকাতা আগমন করলে উভয় শহরে ধর্মঘট পালিত হয়। সারাদেশে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন চলতে থাকে। মুসলমানেরা বৃটিশ সৈন্যবাহিনী ত্যাগের হুমকি দেয়। সারাদেশে অসহযোগ গণআন্দোলন প্রতিরোধের আন্দোলনে পরিণত হয়। বহু মুসলমান দেশ ছেড়ে আফগানিস্তানে হিজরত করে। শেষ পর্যন্ত গান্ধীর অহিংস স্বরাজ আন্দোলন সীমা লংঘন করে এবং উভয় প্রদেশের চৌরিচোরা নামক স্থানে একদল বিক্ষুব্ধ জনতা থানা আক্রমণ করে ২১ জন সিপাহী ও ১ জন সাব-ইন্সপেক্টরকে জীবন্ত দগ্ধ করে। প্রায় একই সময় মানারোরে মেপিনা কৃষকেরা জমিদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। গান্ধী তার অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলনও এরূপ সহিংসতায় পরিণত হতে দেখে মর্মাহত হন এবং তিনি উপলব্ধি করেন যে, অহিংস সংগ্রামের জন্য দেশবাসী প্রস্তুত নয়। সুতরাং তিনি আন্দোলন বন্ধ করার ডাক দেন। ১৯২২ খৃস্টাব্দে বৃটিশ সরকার গান্ধীকে গ্রেফতার করেন এবং তাকে ছয় মাসের কারাদন্ডে দন্ডিত করেন। ফলে অসহযোগ আন্দোলন ক্রমশ স্তিমিত হয়ে পড়ে।
অসহযোগ আন্দোলনের পরিণতিতে খিলাফত আন্দোলনও ক্রমশ স্তিমিত হয়ে পড়ে। কারণ, ইতোমধ্যে তুরস্কে কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও নবজাগরণের সঞ্চার হয়। ১৯২৪ খৃস্টাব্দে কামাল আতাতুর্ক রাজতন্ত্র ও খেলাফত উঠিয়ে দিয়ে তুরস্কে সাধারণতন্ত্র প্রচলন করেন। এর ফলে বিগত খেলাফত আন্দোলনের যবনিকাপাত ঘটে।
আপাতঃদৃষ্টিতে খিলাফত আন্দোলন ব্যর্থ হলেও এই আন্দোলন সারা ভারতে বৃটিশবিরোধী শক্তিকে উজ্জীবিত করেছিল। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন এই দেশের স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করেছিল এ বিষয়ে কোন দ্বিমত নেই এবং খেলাফত আন্দোলনই রাজনীতি ক্ষেত্রে ভারতীয় মুসলমানদের মনে আত্মবিশ্বাস সঞ্চার করে ও তাদেরকে সর্বপ্রথম সক্রিয় গণআন্দোলনে ও স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তাই আমাদের পাক-ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে খিলাফত আন্দোলনের অবদান ও গুরুত্ব অপরিসীম।