ঢাকা শহর এবং কিছু কথা

ঢাকা পৃথিবীর খারাপতম দ্বিতীয় বাসযোগ্য শহর এবং কিছু কথা

বিদেশে বসে দেশকে নিয়ে কিছু লেখার খুব একটা অর্থ আমার কাছে নেই। কারন, দেশের সেই সমস্যাগুলো নিত্যদিন আমাদেরকে স্পর্শ করছে না। আমরা প্রবাসীরা সেগুলোর সাথে সরাসরি যুক্ত নই। সেই সমস্যাগুলো আমাদের মনে কষ্ট তৈরী করতে পারে। কিন্তু সেটা দুঃখবিলাসের চেয়ে খুব বেশি কিছু নয়। কারণ, আমরা এখানে বসে যতই কাঁদি না কেন, সেই কান্নার নোনাজল দেশের কর্তাব্যক্তিদের টেবিলের উপর ট্রান্সপারেন্ট কাঁচের উপর রাখা গরম চায়ের বাড়তি পানির সাথে মিলিয়ে যাওয়ার মতোই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তারা যখন বিপদে পড়েন, কিংবা দেশ যখন কোন ক্রাইসিসের ভেতর দিয়ে যায়, যখন টাকার প্রয়োজন পড়ে, কিংবা বিদেশে কেউ ভালো করে ফেলেন, তখন তাদেরকে বুকে টেনে নেয়ার মতো কিছু ব্যাপার ঘটে - অনেকটা কেরসিন শিখা বলে, এসো মোর দাদা-র মতো।
তাই ভেবেছিলাম, যতদিন দেশের মাটিতে না যাচ্ছি, ততদিন আর দেশ নিয়ে কিছু লিখবো না। কিন্তু গত কয়েকদিন হলো একটি খবর এমনভাবে মনোকষ্টের কারন তৈরী করেছে যে, অনেক কষ্টেও নিজেকে কলম ধরা থেকে রুখতে পারলাম না। কেউ এটাকে ধৃষ্ঠতা হিসেবে নেবেন না বলেই আশা করছি।
খবরটি হলো বিশ্ববিখ্যাত ইকোনোমিষ্ট পত্রিকার। প্রতিবছরের মতো তারা এবারো পুরো পৃথিবীর দেশগুলোর মধ্যে বাসযোগ্য শহরগুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। সারা বছর জুড়ে তারা তথ্য উপাত্ত যোগাঢ় করে তাদের গবেষণা দল একটি তালিকা বের করেছে যেখানে বিশ্বের সবচে ভালো বাসযোগ্য শহরগুলোকে দেখানো হয়েছে। সেই তালিকায় প্রথম রয়েছে কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহর। সারা পৃথিবীর প্রথম দশটি বাসযোগ্য শহরের মধ্যে ভ্যাঙ্কুভার এক নম্বরে। গত বছরও তারা প্রথম স্থানেই ছিল।

একটু বৃষ্টি হলেই এই হাল ঢাকা শহরের
একটি শহরের ষ্ট্যাবিলিটি, স্বাস্থ্য সেবা, সংস্কৃতি, পরিবেশ, শিক্ষা, ইনফ্রাষ্ট্রাকচার, নিরাপত্তা ইত্যাদি ত্রিশটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে যে নম্বর দেয়া হয়েছে তাতে ভ্যাঙ্কুভার পেয়েছে শতকরা ৯৮ ভাগ। মোট ১৪০টি শহরের ভেতর যে দশটি শহর সবচে বেশি বাসযোগ্য তারা হলো ১. ভ্যাঙ্কুভার (কানাডা) ২. ভিয়েনা (অষ্ট্রিয়া) ৩. মেলবোর্ন (অষ্ট্রেলিয়া) ৪. টরোন্টো (কানাডা) ৫. ক্যালগ্যারী (কানাডা) ৬. হেলসিঙ্কি (ফিনল্যান্ড) ৭. সিডনী (অষ্ট্রেলিয়া) ৮. পার্থ (অষ্ট্রেলিয়া) ৯. অ্যাডেলাইড (অষ্ট্রেলিয়া) এবং ১০. অকল্যান্ড (অষ্ট্রেলিয়া)। দেখা যাচ্ছে দশটির তিনটিই হলো কানাডার, আর চারটি অষ্ট্রেলিয়ার শহর। এখানে উল্লেখ্য যে, এই দুটো দেশই সারা পৃথিবী থেকে বিভিন্ন মানুষকে ইমিগ্রেশন দিচ্ছে; এবং সোসালিষ্ট দেশ হিসেবে সুপরিচালিত। হয়তো বর্তমান সময়ে এটাই সবচে ভালো রাষ্ট্র পদ্ধতি। পুজিবাদ নির্ভর দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনও শহর এই তালিকায় দশের ভেতর নেই। লস এঞ্জেলেসের অবস্থান ৪৭তম, নিউইয়র্কের অবস্থান ৫৬তম এবং লন্ডনের অবস্থান ৫৪তম।
ব্যক্তিগত ভাবে আমি ভ্যাঙ্কুভার শহরটি দেখেছি। আমি যদি আরো কিছু বছর আগে ভ্যাঙ্কুভারটা দেখতে পেতাম, তাহলে হয়তো আমি ওখানেই থাকাটা বেছে নিতাম। ভ্যাঙ্কুভার এমন সুন্দর একটি শহর যার প্রেমে না পড়ে কোনও উপায় নেই। ভ্যাঙ্কুভারের কথা এলে একটি ছোট উদাহরণ না দিলেই নয়। আমার এক আত্মীয় থাকেন ওই শহরে। ভদ্রলোক ক্যাডেট কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। ভ্যাঙ্কুভারে আমরা তার ছোট বাসাটাতেই ছিলাম। বুড়োবুড়ি দু’জন মিলে থাকেন। তখুনি জানলাম, সরকারী হাসপাতালের নার্স প্রতিদিন বাড়িতে এসে তাকে সেবা করে যাচ্ছেন। এগুলো বইতে ছোটবেলায় পড়তাম। এখন নিজের চোখে দেখলাম। আমরা ফিরে আসার কিছুদিন পর একদিন শুনলাম ভদ্রলোকের ষ্ট্রোক করেছে। পনেরো মিনিটের ভেতর সরকারী এ্যাম্বুলেন্স এসে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। তার মাথার ভেতরে রক্তক্ষরন ছিল সেজন্য জটিল অপারেশন করেছে, আই.সি.ইউ-তে থেকে পুরো বিপদ কেটে গেলে বাসায় ফিরেছেন। ভদ্রলোক এখন বেশ সুস্থ্য আছেন। ডাক্তার বলেছিলেন, যদি তার অপারেশন আর পনেরো বিশ মিনিটের ভেতর করা না যেতো, তাহলে তাকে বাঁচানো যেতো না। এবং তার এই চিকিৎসার জন্য নিজের পকেট থেকে একটি পয়সাও খরচ করতে হয়নি। আমি কোনও তুলনা করার জন্য উদাহরনটি দেইনি। শুধু বলতে চাইলাম, সেবা কী মানের হতে পারে, এবং একটি রাষ্ট্রের ফাংশন কী হতে পারে। তারা ধনী দেশ, লোক সংখ্যা কম, তারা অনেক কিছুই পারে। তার সাথে বাংলাদেশের তুলনা করাটা ঠিক হবে না। কিন্তু মানুষের যখন জীবন-মরনের সমস্যা হয়ে দাড়ায়, তখন হয়তো সবাই একটু ভালো চিকিৎসার জন্য খরকুটোটুকুও আকড়ে ধরতে চাইবে। এটাই স্বাভাবিক।

এই ট্রাফিক জ্যাম থেকে যেন আমাদের মুক্তি নেই
এবারে বসবাস যোগ্যতার তালিকায় সবচে খারাপ শহরগুলোর নাম দেখা যাক - ১. হারায়ে (জিম্বাবুয়ে) ২. ঢাকা (বাংলাদেশ) ৩. আলজিয়ার্স (আলজেরিয়া), ৪. পোর্ট মোরেসবি (পাপুয়া নিউ গিনি) ৫. লাগোস (নাইজেরিয়া) ৬. করাচী (পাকিস্তান) ৭. ডাউয়ালা (ক্যামেরুন) ৮. কাঠমুন্ডু (নেপাল) ৯. কলোম্বো (শ্রীলংকা) এবং ১০. ডাকার (সেনেগাল)। এর অর্থ হলো, ঢাকা শহর হলো নীচের দিক থেকে দ্বিতীয়। ঢাকা শহর যে তালিকায় ঠিক জায়গায় নেই, এই কথাটি কেউ বলেননি। ফেসবুক এবং অন্যান্য ওয়েব সাইটে যখন এই খবরটি আমি অন্যদের সাথে শেয়ার করেছি, সবাই এক বাক্যে মেনে নিয়েছেন যে, ইকোনোমিষ্টের তালিকা ঠিকই আছে। এটা টি.আই.বি-র রিপোর্টের মতো বিতর্কিত বলে মনে হয়নি।
ঢাকা শহরের সমস্যাগুলো কতটা প্রকট সেটা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এই মাস খানেক আগেই আমি ঢাকা গিয়েছিলাম। ময়মনসিংহ থেকে আমার গাজীপুর আসতে সময় লাগলো দুই ঘন্টা, আর গাজীপুর থেকে ধানমন্ডি যেতে পাঁচ ঘন্টা। বিকেলে ময়মনসিংহ থেকে যাত্রা করে গভীর রাতে ঢাকা পৌছালাম। ঢাকায় জীবন ধারন প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে, এই কথাটি আমার নয়, ঢাকায় যারা থাকেন তারাই প্রতিদিন বলছেন। কোনও একটা কিছু যদি পরিকল্পনা মাফিক হতো! ঢাকা শহর এবং বাংলাদেশ তো এখন আর বর্গিরা পরিচালনা করছে না, আমাদের শহর এবং দেশ আমরাই চালাচ্ছি। এটাই কি একটা খুব বড় পরিমাপ নয় যে, আমরা কেমন চালাচ্ছি। আমাদের ক্যাপাবিলিটি কেমন - সেটা পরিমাপের জন্য আর কী কিছুর প্রয়োজন? পুরো শহরটি যখন পুরোনো ঢাকার মতো গলিতে পরিনত হবে, তখন হয়তো আমরা নতুন করে কিছু করতে শুরু করবো। আমি জানি অনেকেই ঢাকা শহরের এই সমস্যাগুলোকে সমাধান করতে বিভিন্নরকমের চিন্তা করছেন। সমস্যার বাইরে থেকে তার সাথে কয়েকটি চিন্তা আমিও যোগ করতে চাই।

ঢাকা সিটি কর্পরেশনের আদৌ কি কোন ভূমিকা আছে?
১. ঢাকা শহরে একজন শিক্ষিত মেয়র চাই, যিনি সত্যিই জানেন একটি উন্নত নগরের জীবন ধারনে কী কী জিনিসের প্রয়োজন। খুব শিঘ্রই ঢাকায় নতুন মেয়রের নির্বাচন হবে। সবগুলো মিডিয়া যদি মানুষকে ভোটের এই ব্যাপারটি সচেতন করতে পারে, তাহলে একটি বেশ বড় কাজ হয়। একজন ভালো মেয়র ছাড়া, একটি ভালো শহর কিছুতেই হতে পারে না। ঢাকা শহরকে যদি বাসযোগ্য করতে হয়, তাহলে চাই একজন স্মার্ট মেয়র, যিনি জানেন আজ থেকে আরো বিশ-পচিশ বছর পরে এই শহরের অবস্থা কী হবে।
২. ঢাকা শহরের পুলিশ এবং পুরো ব্যবস্থাপনা থাকবে মেয়রের অধীনে। মেয়রের কাজ যদি হয় শুধু ময়লার গাড়ি ঠিক করা, তাহলে সেই শহর তো বস্তিতে পরিনত হবেই। ঢাকা শহরের পুরো প্রসাশন থাকতে হবে মেয়রের অধীনে। ঢাকা শহরের মালিক প্রধানমন্ত্রী নন, মেয়র। মেয়র হলো মূলত তাকে ঢাকা শহরে থাকতে দিয়ে, আতিথিয়তা দিয়ে রেখে নিজেকে ধন্য করছে। পৃথিবীর উন্নত বিশ্বে পুলিশ, নিরাপত্তা বাহিনী, প্রসাশন - এগুলো মেয়রের অধীনেই থাকে। এবং এটা খুব ভালো কাজও করে। আমরা অনেক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। এগুলোও আমাদের চিন্তা করতে পারতে হবে।
৩. ঢাকা শহরে অনেকেই বিভিন্ন রকমের পরিবহন ব্যবস্থার কথা বলে থাকেন। পাতাল রেল, মাটির উপর দিয়ে রেল, ঘন ঘন বাস ইত্যাদি। এগুলো আমাদের কোনটাই কাজ করবে না। প্রত্যেকটির বিভিন্ন অসুবিধা আছে। আবার পাবলিক পরিবহনের সাথে নিরাপত্তার বিষয়গুলো খুব জড়িত। সমাধান হলো, আমাদের কাউকে না কাউকে ঢাকা শহর ছাড়তেই হবে। এটাই এখন বাস্তবতা। যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান ঢাকা শহর ছেড়ে যেতে পারে তার মধ্যে প্রথম হলো ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট। এবং তারপর বি.ডি.আর পিলখানা। গুগুল আর্থে গিয়ে ঢাকা শহরকে দেখতে গেলে, সেই স্যাটেলাইট ম্যাপে সেনানীবাস আর পিলখানাই সব জায়গা দখল করে আছে দেখা যায়। একটি মূল শহরের পেটের ভেতর পৃথিবীর আর কোথাও ক্যান্টনমেন্ট আছে? আমাদের সেনাবাহিনী তো এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যায়। তারা কেউ বলুক তো, কোন দেশে জনবহুল এই শহরের পেটের ভেতর সেনানীবাস রয়েছে? একইভাবে বিডিআর-কেউ পিলখানা ছেড়ে যেতে হবে। সবচে ভালো হতো, যদি ঢাকা শহরের লোকজনকেই সড়িয়ে নেয়া যেতো। কিন্তু এই দুটো প্রতিষ্ঠান সুশৃঙ্খল। তাদেরকে সড়িয়ে নেয়া অনেক কম ঝামেলার হবে। খুজে খুজে এমন আরো কিছু বড় প্রতিষ্ঠান বের করতে হবে, যেগুলোকে ঢাকা শহর থেকে অন্যত্র সড়িয়ে নিতে হবে।
৪. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেও ঢাকা থেকে অন্যত্র সরে যেতে হবে। আমাদের সবাইকে ঢাকা থাকতে হবে কেন? যেখানে রান্না করবো, সেখানেই খাবো, সেখানেই ঘুমাবো আবার সেখানেই মল ত্যাগ করবো - এই কনসেপ্ট থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। পুরো দেশটাই আমাদের। এবং উন্নয়ন পুরো পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের অধিকার। শুধু ঢাকার মাটির একা সেই অধিকার নয়।
৫. ভূমি দস্যুতা বন্ধ করতে হবে। এবং সেটা সরকার একা করতে পারবে তা নয়। আমরা যারা ভূমি দস্যুদের কাছ থেকে অধিক টাকায় জমি কিনি, তারাও সমানভাবে দায়ী। আমরা তো জেনে শুনেই সেই জমিগুলো কিনছি এবং সরাসরি ভূমি দস্যুদের কাজকে আরো শক্তিশালী করছি, তাই না? অনেকেই হয়তো বলতে পারেন, জমি কিভাবে দখল হয় সেটা তো ক্রেতা হিসেবে আমার দেখার কথা নয়! তার উত্তর হলো, অবশ্যই দেখার কথা। আর যদি দেখার কথা না হয়, তাহলে ধরে নিন ঢাকা শহরের পরিবেশ দূষনের ভারে আপনার সন্তান যখন পঙ্গু হয়ে জন্মাবে, আপনার কিশোর শিশু যখন ব্রেইন ডিফেক্ট হবে, আপনার সন্তান যখন অকালে তার বাবাকে হারাবে, তার মাকে হারাবে, আপনার সন্তানকে যখন এ্যাম্বুলেন্স ট্রাফিক জ্যামের কারনে হাসপাতালে নিতে পারবে না, আর তখন আপনি রাস্তায় চিৎকার করে কারো সাহায্য চাইবেন - সেদিন সেই সাহায্যটুকুও যখন আসবে না, সেদিনও কারো কিছু বলার থাকবে না, দেখার থাকবে না।
এখনও সময় আছে। চলুন, আমাদের সন্তানদের জন্য আমরা এই কাজগুলো করতে শুরু করি। আজকে শুরু করতে না পারলেও, ভাবতে তো শুরু করি। তারপর একদিন ঠিকই পেরে যাবো। মানুষ পারে না, এমন তো কিছু নেই!